Print Date & Time : 4 July 2025 Friday 6:36 pm

ইসলামিক ব্যাংকগুলোর আমানত ২% কমেছে

শেখ শাফায়াত হোসেন : আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে ড. আহসান এইচ মনসুর বেশ কয়েকটি ইসলামিক ধারার ব্যাংক পুনর্গঠন করেন। তবে তার এক বক্তব্যে কয়েকটি ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নেয়ার হিড়িক পড়ে। এর বেশিরভাগই ছিল শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক। ওই আমানতের একটি অংশ চলে যায় সনাতনী কয়েকটি বড় ব্যাংকে। তখন নিট আমানতের বড় প্রবৃদ্ধি ঘটায় ঘটা করে তা উদ্যাপন করে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে দিয়ে ব্যাংক খাতের মোট আমানতে ইসলামিক ব্যাংকগুলোর অংশগ্রহণ কমে আসে প্রায় দুই শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি ২০২৫ সালের মার্চ মাস শেষে দেশের ব্যাংক খাতের মোট আমানতে ইসলামিক ব্যাংকগুলোর অংশগ্রহণ কমে ২৪ দশমিক ৩৬ শতাংশে নেমে এসেছে।

অথচ ২০২৪ সালের জুন মাস শেষে ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ২৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ ছিল ইসলামিক ব্যাংকগুলোর হাতে।

ঠিক এক বছর আগে, অর্থাৎ ২০২৪ সালের মার্চে ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ২৬ দশমিক ২৩ শতাংশ ছিল ইসলামিক ব্যাংকগুলোর হাতে। সেই হিসেবে এক বছরে ব্যাংক খাতের মোট আমানতে ইসলামিক ব্যাংকগুলোর দখল কমেছে প্রায় দুই শতাংশীয় পয়েন্ট।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত মার্চ মাসে দেশের ব্যাংক খাতে মোট আমানত ছিল ১৮ লাখ ১৮ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামিক ব্যাংকগুলোর হাতে ছিল ৪ লাখ ৪২ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা।

গত বছরের জুন শেষে মোট আমানতের মধ্যে ৪ লাখ ৪৫ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা ছিল ইসলামিক ব্যাংকগুলোর হাতে। ওই বছরের মার্চে ব্যাংক খাতের মোট আমানতের মধ্যে ৪ লাখ ৩৪ হাজার ২২৯ কোটি টাকা ছিল ইসলামিক ব্যাংকগুলোর দখলে।

সে হিসাবে গত এক বছরে ইসলামিক ব্যাংকগুলোর আমানত শূন্য দশমিক ৮০ শতাংশ বেড়েছে। তবে ব্যাংক খাতের মোট আমানত বাড়ায় ইসলামিক ব্যাংকগুলোর অংশগ্রহণ ২৬ শতাংশ থেকে ২৪ শতাংশে নেমে এসেছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশের বর্তমানে পূর্ণাঙ্গরূপে চালু থাকা ১০টি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক হলো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, আল-আরাফাহ্ ইসলামিক ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামিক ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামি ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক।

এর মধ্যে ছয়-সাতটি ব্যাংক ছিল চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। গত বছরের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের পর ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

ইসলামিক ব্যাংকগুলোর সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোসলেহ উদ্দিন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ইসলামিক ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা অনেক বেশি টেকসই হয়। এটা সারা বিশ্বেই প্রমাণিত। আমাদের দেশেও আমরা এই ধারার ব্যাংকগুলোর উন্নতি দেখতে পেয়েছি গত ৩০-৪০ বছরেরও বেশি সময়ে।’

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে এ খাতের ব্যাংকগুলোয় কিছুটা ধাক্কা লাগলেও ইসলামিক ব্যাংকগুলো তা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে বলে মনে করছেন এই ব্যাংক এমডি। তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একীভূত করার উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে এ খাতের ব্যাংকগুলো আরও শক্তিশালী হবে।’
গত বছরের ১৩ আগস্ট গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পান ড. আহসান এইচ মনসুর। ওই বছরের ৮ সেপ্টেম্ব এক অনুষ্ঠানে গভর্নর সাংবাদিকদের বলেন, ’১০-১২টি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে বসে আছে।’

এর পরপরই কিছু ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নেওয়া শুরু করেন গ্রাহকরা। বিশেষ করে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন কয়েকটি ব্যাংক থেকে আমানত তোলার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় গ্রাহকের আমানত ফেরত দেয়া কমিয়ে আনে ব্যাংকগুলো। এতে গ্রাহকদের মধ্যে অনিশ্চয়তা ও আস্থাহীনতা দেখা দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে ধার দেবে না, এমন সিদ্ধান্ত নিলেও পরে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। ধীরে ধীরে কিছুটা স্বাভাবিক হতে থাকে পরিস্থিতি। ইতোমধ্যে এ খাতের পাঁচটি দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে।

ইসলামিক ব্যাংকগুলোর দুর্বল হয়ে পড়া এবং পট পরিবর্তনের ডামাডোলে এ খাতের ব্যাংকগুলোর আমানতে যতটা প্রভাব ফেলেছে, ততটা ঋণাত্মক প্রভাব নেই বা বিনিয়োগ কমেনি। গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের মধ্যে ইসলামিক ব্যাংকগুলোর অংশগ্রহণ ছিল ২৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ। গত বছরের জুনে ব্যাংক খাতের মোট ঋণে ইসলামিক ব্যাংকগুলোর অংশগ্রহণ ছিল ২৮ দশমিক ২২ শতাংশ এবং ওই বছরের মার্চে ছিল ২৮ দশমিক ২৪ শতাংশ।

অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকঋণে ইসলামিক ব্যাংকগুলোর অংশগ্রহণ আগের থেকে বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত মার্চে ব্যাংক খাতে মোট ঋণ ছিল ১৭ লাখ ৩৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামিক ব্যাংকগুলোর দেয়া বিনিয়োগ বা ঋণ ছিল ৫ লাখ ২ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ইসলামিক ধারার ১০টি ব্যাংকের দেশে শাখা রয়েছে ১ হাজার ৬৯৯টি। এ ছাড়া প্রচলিত ধারার ১৭টি ব্যাংকের ৩৭টি ইসলামিক ব্যাংকিং শাখা ও ২০টি সনাতনী ধারার ব্যাংকের ৮৩০টি ইসলামিক উইন্ডো রয়েছে।
আলোচিত সময়ে ব্যাংক খাতের মোট কৃষিঋণের মধ্যে ১ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা বিতরণ করেছে ইসলামিক ধারার ব্যাংকগুলো।

২০২৫ সালের জানুয়ারী-মার্চ সময়ে ইসলামিক ধারার ব্যাংকগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক দায়বদ্ধ (সিএসআর) কার্যক্রমের ব্যয় ছিল ৪৯ কোটি টাকা, যা ২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বরে সময়ে ছিল ৭৮ কোটি টাকা এবং ২০২৪ সালের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ছিল ৮৫ কোটি টাকা।