Print Date & Time : 21 July 2025 Monday 12:43 am

ইসলামি অর্থনীতিতে এগোচ্ছে আফগানিস্তান

. মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা: পৃথিবী যখন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে অন্ধকারে নিপতিত, ঠিক তখনই মহান আল্লাহতায়ালা আরবের মরু প্রান্তরে ইসলামের শেষ নবী হিসেবে হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেন মানবতার মুক্তির দূত হিসেবে এবং ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির গাইডলাইন হিসেবে নাজিল করেন আল কোরআন। মানুষের বাস্তবজীবনের সকল সমস্যার সমাধান রাসুল (সা.) নিজে বাস্তবজীবনে ব্যবহারের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন সাহাবায়ে কেরামগণকে। সাহাবাগণ সেই অনুযায়ী তাঁদের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সমাজে ইসলামি অর্থব্যবস্থা কায়েমের ফলে আর্থসামাজিক কল্যাণ সাধিত হয়। যে সমাজে যত বেশি ইসলামি আইনকানুন মানা হতো সে সমাজে তত বেশি অর্থনৈতিক মুক্তি সাধিত হতো। তারই ধারাবাহিকতায় ডিজিটাল আধুনিক যুগে বর্তমান সময়ের বিভিন্ন দেশের ইসলামি স্কলারগণ কোরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াসের আলোকে মানবজীবনের সকল সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছেন। সুরা আল-ইমরান, আয়াত ১৯-এ মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ইন্নাদ্বিনা ইন্দাল্লাহিল ইসলাম অর্থ: ‘নিঃসন্দেহে (মানুষের) জীবন-বিধান হিসেবে আল্লাহতায়ালার কাছে একমাত্র (গ্রহণযোগ্য) ব্যবস্থা ইসলাম’। সুতরাং ইসলামি অর্থনীতি সেই ইসলামি জীবনব্যবস্থার এক অপরিহার্য অংশ। ইসলামি অর্থব্যবস্থা মানব কল্যাণময়, বৈজ্ঞানিক, ভারসাম্যপূর্ণ এবং ক্রমবিকাশমান অর্থব্যবস্থা। ইসলামি অর্থনীতি পুঁজিবাদী বা সমাজবাদী তথা যেকোনো অর্থব্যবস্থার তুলনায় অনেক বেশি আধুনিক এবং মানবতার জন্য কল্যাণকর। ইসলামি অর্থব্যবস্থা বাস্তবায়নের ফলে খোলাফায়ে রাশেদার যুগে জাকাত গ্রহণ করার মতো কোনো লোক খোঁজে পাওয়া ছিল দুষ্কর। অতএব, যে সমাজ বা রাষ্ট্র ইসলামি বিধিবিধান অনুযায়ী সমাজের সকল স্তরে আর্থিক কাঠামো গড়ে তুলে সে সমাজ দিন দিন উন্নতি সাধন করে। ইতিহাস তার সাক্ষী। বর্তমান ডিজিটাল আধুনিক যুগে আফগানিস্তানের তালেবান সরকার ২০২১ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশকে সমৃদ্ধির অর্থনীতির দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে ইতোমধ্যে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তারা অসম্ভবকে সম্ভব করেছে ইসলামি আর্থিক নীতিমালা অনুসারে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কার্যকলাপ পরিপালনের মাধ্যমে।

ইসলামি অর্থনীতি: মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক তথা সার্বিক মুক্তি, কল্যাণ ও উন্নয়ন সাধিত হয় একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালা কর্তৃক প্রদত্ত জীবনব্যবস্থার মাধ্যমে। আর এ জীবনব্যবস্থার নাম হলো ইসলাম। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতিসহ মানবজীবনের সকল বিভাগকে পরিচালনা করতে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়েছে ইসলাম। তাই ইসলামি অর্থনীতিই অর্থনৈতিক মুক্তির উন্নয়নের একমাত্র চাবিকাঠি। আল কোরআন ও হাদিসের আলোকে সৃষ্টির লালনপালনের যাবতীয় জাগতিক সম্পদের সামগ্রিক কল্যাণধর্মী ব্যবস্থাপনাকে ইসলামি অর্থনীতি বলে।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মিসরীয় অর্থনীতিবিদ এম উমর চাপড়া ইসলামি অর্থনীতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন,Islamic economics is that branch of knowledge which helps to realize human well-being through an allocation and distribution of scarce resources that is in conformity with Islamic teachings without unduly curbing individual freedom or creating continued macro-economic and ecological imbalances. অর্থাৎ, ইসলামি অর্থনীতি জ্ঞানের সেই শাখা, যা ইসলামের শিক্ষার সঙ্গে সংগতি রেখে দুষ্প্রাপ্য সম্পদের বণ্টন ও বরাদ্দের মাধ্যমে এবং ব্যক্তির স্বাধীনতা অযথা খর্ব ও সামষ্টিক অর্থনীতি এবং পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি না করে মানবীয় কল্যাণ অর্জনে সহায়তা করে।

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এম নেজাতুল্লাহ সিদ্দিকী বলেন: Islamic economics is the Muslim thinkersÕ response to the economic challenges of their times.  অর্থাৎ ইসলামি অর্থনীতি সমকালীন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মুসলিম চিন্তাবিদদের জবাব।

লেখক: ড. মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা

দীর্ঘ বিশ বছর তালেবান যোদ্ধারা আমেরিকা ও স্থানীয় ক্ষমতাশীন সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে এবং দেশটির নাম রাখেন ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পশ্চিমারা নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে আফগানিস্তানের সংরক্ষিত ৯৫০ কোটি ডলার জব্দ করে রাখে, যার ৭০০ কোটি ডলার আটকে রাখা হয় আমেরিকান ব্যাংকে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠী তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে নেয় আফগানিস্তান থেকে। যার ফলে ৪ কোটি জনসংখ্যার এই দেশটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুর্দশা, পশ্চিমা দেশগুলোর কঠোর নিষেধাজ্ঞার ফলে ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। বৈদেশিক সাহায্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল আফগান অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে। ফলে দেশটি বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে এক রকম বিচ্যুত হয়ে যায়। মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে থাকে এবং দিনে দিনে বেকার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। নগদ অর্থের সংকট দেখা দেয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশটিতে ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের নগদ অর্থ সহায়তা দেয়া হয়। হিসাব অনুযায়ী সরকারি ব্যয়ের ৭৫ শতাংশই বৈদেশিক সাহায্য থেকে মেটানো হয়।

করোনাভাইরাস উত্তর বৈশ্বিক মন্দা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবসহ নানা কারণেই অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মুদ্রার মান কমেছে। ২০২১ সালের নভেম্বরে এক মার্কিন ডলারের মূল্য ছিল ১৩০ আফগানি। বর্তমানে সারাবিশ্বকে চমকে দিয়েছে আফগানিস্তানের অর্থব্যবস্থা। ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে আফগানিস্তানের মুদ্রা আফগানির মান। সেপ্টেম্বর মাসে আফগানির রেট যে হারে বেড়েছে তা বিশ্বব্যাংকও কার্যত বিস্মিত করেছে। এমনকি এই বৃদ্ধির নিরিখে দেশটির মুদ্রা পেছনে ফেলে দিয়েছে ডলার ও রুপিকেও। মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ব্লুমবার্গের বরাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, বৈদেশিক সহায়তা ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক কার্যক্রম বৃদ্ধির ফলে চলতি কোয়ার্টারে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে অন্যতম সেরা মুদ্রা হয়েছে আফগানি। ফলে সারাবিশ্বের নজর কেড়েছে আফগানিস্তানের এই মুদ্রা।

মুদ্রার ইতিহাস: আফগান রুপি ১৯২৫ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের মুদ্রা ছিল। ১৮৯১ সালের আগে রৌপ্য মুদ্রার সঙ্গে তামার ফলস এবং সোনার মোহর প্রচলিত ছিল। তিনটি ধাতুর মধ্যে নির্ধারিত কোনো বিনিময় হার ছিল না এবং এটির সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল তাদের নিজস্ব মুদ্রা প্রচলন করে। ১৮৯১ সালে কাবুলি রুপির ওপর ভিত্তি করে নতুন নতুন মুদ্রা চালু করা হয়েছিল। বর্তমানে প্রচলিত মুদ্রা আফগানি দ্বারা রুপি প্রতিস্থাপিত হয়েছিল ১৯২৫ সালে, কিন্তু ১৯৭৮ সাল থেকে এটির প্রচলন শুরু হয়।

মুদ্রাস্ফীতির হার: বিশ্বব্যাংকের ২০২৩ সালের ২৭ জানুয়ারি একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের জুলাইয়ে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ।  ওই বছরের ডিসেম্বরে সেটা এক লাফে কমে হয়েছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। এরপর তিন মাসের ব্যবধানে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে মুদ্রাস্ফীতি রেকর্ড পরিমাণ কমে হয়েছে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। মার্চ মাসে তা কমে হয়েছে ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ। জুলাই মাসের শুরুতে ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, এপ্রিল ও মে পরপর দুই মাসের মূল্যস্ফীতি আগের মাসের তুলনায় নিম্নগামী ছিল। এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ঋণাত্মক (-১) শতাংশ; যা মে মাসে আরও কমে (-২.৮) শতাংশ হয়ে যায়। প্রকাশিত এই তালিকায় আফগানিস্তান সবচেয়ে উন্নত, শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশের চেয়েই এগিয়ে রয়েছে। খাদ্যদ্রব্যসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী এবং পেট্রোলিয়াম পণ্যের দাম অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে কম এবং স্থিতিশীল পর্যায়ে রয়েছে।

চলতি অর্থবছরে প্রথমবারের মতো অর্থ মন্ত্রণালয় এই তথ্যও জানিয়েছে, আফগান মুদ্রার বিপরীতে ডলার তার মূল্য হারিয়েছে এবং আফগানির মূল্যমান একটি স্থায়ী স্থিতিশীল পর্যায়ে পৌঁছেছে। যার ফলে প্রায় ৩ গুণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মোট জাতীয় উৎপাদন-জিডিপিতে।

আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য: আফগানিস্তান এমন একটি দেশ যে দেশে রয়েছে পাহাড়, পর্বত; যেখান থেকে প্রচুর পরিমাণে ফল ও অন্যান্য কৃষিপণ্য রপ্তানি হয়। আফগানিস্তানে রপ্তানির তুলনায় আমদানির পরিমাণ কম। রাজস্ব আদায় ও রপ্তানির ক্ষেত্রে আগের সরকারের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২ সালের রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ১৮০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২১ ও ২০২০ সালে এই রপ্তানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৯০ ও ৮০ কোটি ডলার।

বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের মাধ্যম: আফগানিস্তানে এখন বিদেশি মুদ্রার লেনদেনের বড় একটি অংশই হয় মানি চেঞ্জারের মাধ্যমে। স্থানীয়ভাবে এদের বলা হয় সারাফ। এসব মানি চেঞ্জার বিভিন্ন বাজারে স্টল খোলে অথবা গ্রামের দোকান থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করে। এসব মানি চেঞ্জারে প্রতিদিন মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার হাতবদল হয়। এ বাণিজ্যে কোনো সীমা নেই। আর্থিক নিষেধাজ্ঞার কারণে আফগানিস্তানে এখন প্রায় সব রেমিট্যান্সই শতাব্দী প্রাচীন হাওয়ালার (হুন্ডি) মাধ্যমে পাঠানো হয়। সারাফগুলোর ব্যবসার মূল অনুষঙ্গই হচ্ছে হাওয়ালা। (সূত্র: দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩) বিদেশি নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন সব ধরনের মুদ্রাই দেশটিতে প্রবেশ করে আফগানির মাধ্যমে। এমনকি দেশটিতে কোনো বিদেশি মুদ্রার কার্যক্রম চলে না।

আফগানি  মুদ্রার মূল্য বৃদ্ধির কারণ: মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ, নগদ অর্থের প্রবাহ ও রেমিট্যান্সের কারণে আফগানিস্তানের মুদ্রা চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (জুলাই- সেপ্টেম্বর) বিশ্বের অন্যতম সেরা মুদ্রা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই তিন মাসে আফগানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৯ শতাংশ। ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, চলতি বছর ডলারের বিপরীতে আফগানির দাম বেড়েছে ১৪ শতাংশ। সেই হিসেবে এ বছর কলোম্বিয়ান পেসো এবং শ্রীলঙ্কান রুপির পরই বিশ্বের তৃতীয় সেরা মুদ্রা হচ্ছে আফগানি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আফগানির এমন সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে বর্তমান তালেবান সরকারের নেয়া কিছু পদক্ষেপ। পদক্ষেপগুলো হলোÑদেশে মার্কিন ডলার ও পাকিস্তানি রুপির ব্যবহার বন্ধ, দেশের বাইরে মার্কিন ডলার নিয়ে যাওয়ার ওপর বিধিবিষেধ আরোপ, অনলাইন বাণিজ্য অবৈধ ঘোষণা ইত্যাদি। এসব আইন না মানলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারের এসব পদক্ষেপের কারণে ক্রমেই বাড়তে থাকে আফগানির মান। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, আফগানিস্তানে রয়েছে আনুমানিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের লিথিয়াম ভাণ্ডার। এই প্রাকৃতিক সম্পদ এবং বৈদেশিক সাহায্য ও অনুদান আফগানি রুপির মান বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। পাশাপাশি রেমিট্যান্স বাড়াতেও নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। রাজধানীর সবচেয়ে বড় মুদ্রাবাজার সরাই শাহজাদার কিছু মানি এক্সচেঞ্জার বলছেন, রপ্তানি বৃদ্ধির কারণেই আফগান মুদ্রার মূল্য বাড়ছে।

বিনিয়োগ কার্যক্রম: যুদ্ধের সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ লুটপাট হয়; যার ফলে বৈদেশিক মুদ্রা ও দেশীয় মুদ্রার সংকট দেখা দিলেও তাদের হাতে সম্পদের অভাব নেই। দেশে যে পরিমাণ লিথিয়াম আছে, তার মূল্য তিন লাখ কোটি মার্কিন ডলার। সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়, তালেবান সরকার লৌহ, আকরিক ও স্বর্ণের খনি নির্মাণে চীনা, ব্রিটিশ ও তুর্কি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ৬৫০ কোটি ডলারের চুক্তি করেছে। চলতি চছরের জানুয়ারি মাসে তেল উত্তোলনের জন্য চীনা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে। পাকিস্তান থেকে পাচার হওয়া ডলারও আফগান অর্থনীতিতে উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা রাখছে। আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সপ্তাহে প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ ডলার নিলামে তুলে দেশীয় মুদ্রাকে শক্তি জোগাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র হাসিবুল্লাহ নুরি এ তথ্য জানান। মুদ্রার ওপর চাপ কমার কারণে ডলার উত্তোলনের সীমাও বাড়িয়েছে আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যবসায়ীদের ডলার উত্তোলনের সীমা মাসিক ২৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৪০ হাজার করা হয়েছে। ব্যক্তির ক্ষেত্রে তা ২০০ থেকে বাড়িয়ে ৬০০ ডলার করা হয়েছে। (সূত্র: প্রথম আলো, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩)

আফগানিস্তান গত ৪৪ বছর রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তির সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার কারণে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়। ফলে স্থিতিশীল আর্থিক কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। দুই বছর আগে তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমদানিতে চোরাচালান, দুর্নীতি কঠোর হস্তে দমন করে। দেশটির ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় পঙ্গুত্ব এবং পশ্চিমাদের উন্নয়ন সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়া সত্ত্বেও তালেবান আফগান মুদ্রার স্থিতিশীলতা, মুদ্রাস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানি বৃদ্ধি ও আমদানি হ্রাস প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লেনদেন সম্পাদন করার জন্য বেশ কিছু আইনে সংশোধন আনয়ন করে। ফলে আর্থিক দুর্নীতি শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। আফগানিস্তানের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হলো কৃষি ও কৃষি থেকে উপার্জিত পণ্যদ্রব্য রপ্তানির বৈদেশিক মুদ্রা। পাশাপাশি রয়েছে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদ। ধারণা করা হচ্ছে, আফগানিস্তানে ১ হাজার ৪০০-এর বেশি প্রাকৃতিক খনি রয়েছে। উল্লেখ্যযোগ্য খনিগুলো হলোÑলিথিয়াম, খনিজ তেল, আকরিক লোহা, মার্বেল, তামা, দস্তা, সোনা, কয়লা এবং সিসা প্রভৃতি। আফগান সরকার ডলারের বিপরীতে আফগানির মূল্য স্থিতিশীল রাখতে টেকসই উপায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে সপ্তাহে দু’বার দেশের বাজারে ডলার নিলাম করে এবং দেশের বাইরে ডলার চোরাচালান রোধকল্পে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করে।

ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের মতে, তালেবান সরকারের সময় আফগানিস্তানের অর্থনীতি কিছুটা স্থিতিশীলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। দেশটির ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় পঙ্গুত্ব এবং পশ্চিমাদের উন্নয়ন সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়া সত্ত্বেও তালেবান সরকার আফগান মুদ্রার স্থিতিশীলতা, মুদ্রাস্ফীতি রোধ, আমদানি পুনরুজ্জীবিতকরণ, রপ্তানি বৃদ্ধি এবং শুল্ক ও কর সংগ্রহ বৃদ্ধিতে অগ্রগতি অর্জন করেছে। (১৯ আগস্ট ২০২৩, www.bahannonews.com

জাতিসংঘের তথ্য মতে, বিশ্বের আফিম রপ্তানির শীর্ষে ছিল আফগানিস্তান। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে আফিমের ব্যাপক উৎপাদন হতো। বছরে ৩০ থেকে ১৬০ কোটি ডলার পর্যন্ত আয় করত। সম্প্রতি তালেবান সরকার সেই আফিম চাষ নিষিদ্ধ করেছে। এটা শরিয়াহ আইনের প্রতিফলন।

আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধির ধারা ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার পেছনে মূলমন্ত্র হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাস্তবায়ন করা। ইসলামি আইনের পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান নামক রাষ্ট্রটি সারাবিশ্বে সারা জাগিয়েছে। আন্তর্জাতিক সহায়তা ছাড়াও যে একটি রাষ্ট্র মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো আফগানিস্তান। ইসলামি শরিয়াহ আলোকে আর্থিক কাঠামো বির্নিমাণ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাই বয়ে আনতে পারে অর্থনৈতিক মুক্তি, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সামাজিক কল্যাণ। সততা ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক কাঠামো যে একটি দেশকে কীভাবে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে পারে এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ আফগানিস্তান। ইসলামি আদর্শের প্রকৃত অনুশীলন যে একটি দেশকে সুখ, শান্তি ও শৃঙ্খলার নিশ্চয়তা দিতে পারে এর আলামত স্পষ্ট হয়েছে আফগানিস্তানের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি দেখে। আশা করা যাচ্ছে, আগামী এক যুগের মধ্যে পাহাড়-পর্বতে ঘেরা এই দেশটি কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত  দেশ গড়বে। উন্নত জাতি হিসেবে গড়ে উঠবে এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতার দিক থেকে ইসলামি রাষ্ট্রগুলোর জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করবে বলে অর্থনীতিবিদরা আশাবাদী ।

কর্মকর্তা, শরিয়াহ সেক্রেটারিয়েট

গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি

Drmdgulammustafa@gmail.com