ইসলামি ব্যাংকগুলোয় আমানতের চেয়ে ঋণ বিতরণ বেশি

নিজস্ব প্রতিবেদক: বিগত সরকারের আমলে দেশের ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। আর এ সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইসলামি ব্যাংকগুলো। ৫ আগস্টের পর খাদের কিনারায় থাকা ব্যাংকগুলো ঠিক করতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এখনও ব্যাংকগুলোর সংকট পুরোপুরি কাটেনি। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিকে ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোতে আমানত কিছুটা বাড়লেও ঋণ বিতরণ বেড়েছে আরও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এমন চিত্র ওঠে এসেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসলামি ব্যাংকগুলোতে সব থেকে বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। অথচ শরিয়াহ ব্যাংকগুলোতে খেলাপির বিষয়ে আরও কঠোর পলিসি আছে। ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী যদি কেউ ইচ্ছাকৃত খেলাপি হয় তবে প্রথম পদক্ষেপ তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে। তাকে আটক রেখে খেলাপি আদায় করে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। এ সবের আমরা কখনও বাস্তবায়ন দেখিনি। খেলাপিদের যাদের সম্পদ আছে সেগুলো বিক্রি করে দেয়ার কথা বলেছিলেন গভর্নর। এটার যদি একটা নজির স্থাপন করতে পারে তবে খেলাপি ঋণের একটা বড় অংশ আদায় করা সম্ভব হবে। তখন মানুষ আবারও এসব ব্যাংকের প্রতি আস্থা ফিরে পাবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর শেষে এসব ব্যাংকের আমানত দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৩৯ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ২৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। একই সময়ে ঋণ বিতরণ হয়েছে ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। এ অঙ্ক মোট বিতরণকৃত ঋণের ২৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। সেই হিসাবে আমানতের চেয়ে ঋণ বিতরণ বেশি হয়েছে ৩৯ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা।
এতে আরও বলা হয়, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ইসলামি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্য ছিল ৯ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা, যা আগের প্রান্তিক শেষে ছিল ১৬৩ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক ছয়টি ব্যাংককে ২৪ হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা দিয়েছে। আর এজন্যই অতিরিক্ত তারল্য বেড়েছে বলে জানিয়েছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

আমানতের তুলনায় বেশি হারে ঋণ বিতরণ করায় এসব ব্যাংকের এডিআর রেশিও (ঋণ-আমানত অনুপাত) বেড়ে গেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডিসেম্বর শেষে শেষে এসব ব্যাংকের এডিআর রেশিও ছিল শূন্য দশমিক ৯৭ শতাংশ। আগের প্রান্তিক সেপ্টেম্বর শেষে যা ছিল দশমিক ৯৬ শতাংশ। আর ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে এডিআর রেশিও ছিল দশমিক ৯৩ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ সময় ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয় বেড়েছে। সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের তুলনায় ডিসেম্বর প্রান্তিকে শরিয়াভিত্তিক এসব ব্যাংকগুলোতে ৩ হাজার ৫০৮ কোটি টাকার রপ্তানি বেড়েছে। একই সময়ে ডিসেম্বর শেষে আমদানি ১৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ বেড়ে ৫৩ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে।
দেশে বর্তমানে ১০টি পূর্ণাঙ্গ শরিয়াহ ব্যাংক ১ হাজার ৬৯৭টি শাখার মাধ্যমে তাদের ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এছাড়া ১৬টি প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংক ৩৪টি ইসলামি ব্যাংকিং শাখা এবং ২১টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ৮২৫টি ইসলামি ব্যাংকিং উইন্ডোর মাধ্যমে সারা দেশে ইসলামি ব্যাংকিং পরিচালনা করছে।

এদিকে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, সমস্যাগ্রস্ত কিছু ব্যাংকের বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সুশাসনের মাধ্যমে সব ব্যাংককে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে, তবে সব ব্যাংক যে বেঁচে যাবে, তা নয়। কারণ কোনো কোনো ব্যাংকের আমানতের ৮৭ শতাংশ একটি পরিবারকে দিয়ে দেয়া হয়েছে। সমস্যায় থাকা ব্যাংকগুলোর অর্ধেকের বেশি ঠিক করা যাবে। বাকিগুলোকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তাদের সম্পদের মান পর্যালোচনার কাজ চলছে। যে গর্তে আমরা পড়েছি, সম্পূর্ণভাবে সমস্যার বাইরে নই। আর মূল্যস্ফীতি কমার বিষয়ে শুরু থেকে যে বলে আসছিলাম ১২ থেকে ১৮ মাস লাগবে, এখনও সে কথাতেই আছি।

দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ছয়টি ব্যাংকের ঋণ বিতরণে বিধিনিষেধ আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া শতভাগ মার্জিন ছাড়া নতুন করে এলসি (ঋণপত্র) না খোলারও নির্দেশনা দেয়া হয়। তবে গত ৫ ডিসেম্বর এলসি খোলার শতভাগ মার্জিনের বাধ্যবাধকতা তুলে নেয়া হয়। ফলে ইসলামি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে আমদানি বিল পরিশোধ বেড়েছে। ডিসেম্বর শেষে ইসলামি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে রেমিট্যান্সের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা, যা এর আগের প্রান্তিকের তুলনায় ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি। শত সংকট সত্ত্বেও প্রবাসীরা ইসলামি ব্যাংকগুলোর ওপর আস্থা রেখেছেন।