ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থায় সম্পদবিহীন কাগজনির্ভর বিনিয়োগের সুযোগ নেই

শেয়ার বিজ: ইসলামি ব্যাংকিংয়ের দ্রুত প্রসার ঘটার কারণ কী মনে করেন?

জাফর আলম: ইসলামি ব্যাংকিং একটি কল্যাণময় ব্যাংকিং ব্যবস্থা।

পদ্ধতিগত ও গ্রহণযোগ্যতার বিচারে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রচলিত সুদনির্ভর ব্যাংকিং ব্যবস্থার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর। ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থায় চক্রবৃদ্ধি সুদ বা অতিরিক্ত লাভ নির্ধারণ, অবৈধ পণ্য বা কাজে বিনিয়োগ, জুয়া, পণ্যের তারতম্য বা অ্যাসেটবিহীন কাগজনির্ভর বিনিয়োগের সুযোগ নেই। এজন্য সব ধর্ম বর্ণের ব্যবসায়ী বা সাধারণ মানুষ ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থায় উপকৃত হয়। কারণ, চক্রবৃদ্ধি সুদ বা অধিক মুনাফা গুনতে হলে শুধু মুসলমান ব্যবসায়ী নয়, বরং হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সব ধর্মাবলম্বী ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আসলে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা সার্বজনীন। এখানে শুধু সওয়াবের বিষয় নয়, বরং পদ্ধতিগত শ্রেষ্ঠত্বের কারণে ইসলামি ব্যাংকিং অধিক জনপ্রিয় এবং দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ও প্রসার হচ্ছে ।

শেয়ার বিজ: বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিংয়ে পূর্ণাঙ্গ শরিয়াহ আইন নেই। এটা কি সমস্যা তৈরি করছে?

জাফর আলম: ইসলামি ব্যাংকিংয়ের মূল নীতিমালা কোরআন, হাদিসে বিদৃত রয়েছে। তাছাড়া ইসলামি অর্থনীতি ও ব্যাংকিং নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম হয়েছে এবং বাজারে ইসলামি ব্যাংকিং সংক্রান্ত যথেষ্ট বইপত্র আছে। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক, সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনসহ সব ইসলামি ব্যাংকে শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটি রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকেরও গাইড লাইন রয়েছে। ফলে ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনায় তেমন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে না। তবে বর্তমানে ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংক রয়েছে। অনেক ব্যাংকে আংশিক শাখা, উইং শরিয়াহ নীতিমালা অনুযায়ী চলছে। সুতরাং ইসলামি ব্যাংকিংয়ের জন্য স্বতন্ত্র আইন বিশেষ প্রয়োজন। এতে ইসলামি ব্যাংকিং পরিচালনা আরও গ্রহণযোগ্য ও সহজতর হবে।

শেয়ার বিজ: আপনারা বিশেষ কিছু পণ্য নিয়ে এসেছেন, বর্তমানে এটার সাড়া কেমন পাচ্ছেন?

জাফর আলম: আমি এসআইবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছি ২০২১ সালের ২১ ডিসেম্বর। ইতোমধ্যে ব্যাংকের উন্নতি, অগ্রগতি ও ভিত্তি শক্ত করতে কিছু ব্যতিক্রম পদক্ষেপ নিয়েছি। তার মধ্যে এমন কিছু আমানত ও বিনিয়োগ পণ্য (ঢ়ৎড়ফঁপঃ) নিয়ে এসেছি যা ইন্ডাস্ট্রিতে একটু ব্যতিক্রম। এসব প্রোডাক্ট মানুষের জীবন জীবিকার উন্নয়নকে সামনে রেখে নিরূপণ করা হয়েছে। মানুষের মৌলিক প্রয়োজন ও সমস্যা সমাধানের বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এসব প্রোডাক্টের মধ্যে এসআইবিএল শিক্ষা, বিবাহ, চিকিৎসা এই তিনটি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। প্রায় আশি হাজার গ্রাহক এই অ্যাকাউন্ট করেছে ইতোমধ্যে। প্রতিদিন এই স্কিম অ্যাকাউন্টগুলো বাড়ছে। এই হিসাবগুলোর বিশেষ সুবিধা হচ্ছে উল্লেখিত প্রয়োজনে আমানতের দ্বিগুণ বিনিয়োগ নিতে পারবে। অতি সম্প্রতি আমরা প্রবাসী, রিটায়ার্ড সিটিজেন ও হকার্স ভাইদের জন্য আরও তিনটি বিশেষ সুবিধাসংবলিত আমানত প্রোডাক্ট নিয়ে এসেছি, যা অল্পদিনে বেশ সাড়া পেয়েছে। হকার্স অ্যাকাউন্ট একের ভেতর দুই। তাদের পুনর্বাসনে ব্যাংক প্রয়োজনে বিনিয়োগ প্রদান করবে। প্রবাসী হিসাবধারীদের হিসেবে ন্যূনতম পাঁচ লাখ জমা থাকলে এবং এসআইবিএলের মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স আনলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট থেকে সিটি করপোরেশনের মধ্যে বাসা বা বাস ট্রেন স্টেশন পর্যন্ত বিনা খরচে ট্রান্সপোর্ট সুবিধা দেয়া হবে। তাছাড়া এসআইবিএল হাসপাতালে সর্বোচ্চ কমিশনে চিকিৎসা সুবিধা পাবে। রিটায়ার্ড সিটিজেন হিসাবধারীরা অধিকতর ওয়েটেজে মাসিক মুনাফার পাশাপাশি তারা হাসপাতালে সর্বোচ্চ কমিশনে চিকিৎসা সুবিধা ও সিটি করপোশনের অভ্যন্তরে ট্রান্সপোর্ট সুবিধা দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া ‘এসআইবিএল ছাদ কৃষি’, ‘এসআইবিএল নাউ’ অ্যাপভিত্তিক অ্যাকাউন্ট ওপেনিং প্রোডাক্টটিও দেশে বিদেশে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। কারও সহায়তা ছাড়া অ্যাপ ব্যবহার করে এই অ্যাকাউন্ট করা যায়। আমাদের ‘ওয়াকফ অ্যাকাউন্ট’, জাকাত অ্যাকাউন্ট, অনূর্ধ্ব আঠার বয়সের ‘ইয়াংগ স্টার অ্যাকাউন্ট বেশ জনপ্রিয়।

 শেয়ার বিজ: বাংলাদেশে বিনিয়োগ ব্যবস্থা প্রসারে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ভূমিকা সম্পর্কে বলেন?

জাফর আলম: দেশের ব্যবসা বাণিজ্য সম্প্রসারণ, শিল্পপ্রতিষ্ঠা ও উন্নয়ন, বৈদেশিক বাণিজ্য এবং রেমিট্যান্স আহরণে ইসলামি ব্যাংকগুলোর অবদান কমবেশি ৩০ শতাংশ। গার্মেন্টস, স্পিনিং মিলস, টেক্সটাইলস, সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ, কৃষিজাত শিল্পসহ প্রতিটি সেক্টরে ইসলামি ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ রয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী চাল, ডাল, গম, ছোলা, চিনি, ভোজ্যতেল প্রভৃতি আমদানি করে বাজার ভারসাম্যে ইসলামি ব্যাংকগুলোর অংশ উল্লেখযোগ্য। ইসলামি ব্যাংকিং তুলনামূলক সহজতর হওয়ায় গ্রাহক ব্যবসায়ীদের আগ্রহও বেশি। আশা করি ইসলামি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ভবিষ্যতে বিনিয়োগ আরও বৃদ্ধি পাবে।

শেয়ার বিজ: ইসলামি ব্যাংকিং বিনিয়োগ অ্যাসেট বেইজ, প্রচিলত ব্যাংকগুলো হলো কাগজভিত্তিক। এরপরেও ইসলামি ব্যাংকিংয়ে ঋণে কিছু ঝামেলা হয়। এটা কেন?

জাফর আলম: এটা সত্যি যে, ইসলামি ব্যাংকিং পদ্ধতি অত্যন্ত স্বচ্ছ ও অ্যাসেটভিত্তিক । ফলে ফান্ড ডাইভার্সনের সুযোগ নেই। ইসলামি ব্যাংকিং বা কনভেনশনাল ব্যাংকিং যা-ই বলেন এটা ব্যাংকার, গ্রাহক সমন্বয়ে পরিচালিত হয়। সুষ্ঠুভাবে ব্যাংকিং করতে হলে ব্যাংকার, গ্রাহক উভয়ের আন্তরিকতা, সহযোগিতা, সমন্বয় দরকার। খেলাপির বিরুদ্ধে আইনের যথার্থ প্রয়োগও অপরিহার্য। পৃথিবীতে কোনো কিছু নিরবচ্ছিন্নভাবে হয় না। ইসলামি ব্যাংকিংয়ের সমস্যার চেয়ে নেতিবাচক প্রচারণা বেশি মনে হয়। আশা করি, ইসলামি ব্যাংকিংয়ের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে। জনগণের ভালো-মন্দ পৃথক করার সক্ষমতা প্রবল। এতদসত্ত্বেও ইসলামি ব্যাংকগুলোর হার তুলনামূলক কম ।

শেয়ার বিজ: বাংলাদেশে শরিয়াহভিত্তিক সরকারি বিনিয়োগে ইকুইপমেন্ট খুব কম। এটা বাড়ানো উচিত কি না?

জাফর আলম: আমাদের দেশে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের যাত্রা ১৯৮৩ সালে। প্রচলিত ব্যাংকিং স্থলে ইসলামি ব্যাংকিং জায়গা করে নেয়ার বিষয়টি সহজতর ছিল না। ইসলামি ব্যাংকিংয়ের আমানত ও বিনিয়োগ পদ্ধতি নীতিমালা রপ্ত করার বিষয়ও এক দিনে হয়নি। এমনকি ইসলামি ব্যাংকিং  বোঝার মতো ব্যাংকারও বেশি ছিল না। এখন কিন্তু পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে।

সরকারি বেসরকারি পর্যায় সুকুক বন্ড বেশ জনপ্রিয়তা ও বাজার পেয়েছে। তবে তা পর্যাপ্ত বলা যাবে না । আরো ইনস্ট্রুমেন্ট দরকার। এক্ষেত্রে ব্যাংকার ও শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটি একসঙ্গে কাজ করতে পারে ।

শেয়ার বিজ: আপনারা ইসলামি ব্যাংকিংয়ের কোন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন কি না?

জাফর আলম: ইসলামি ব্যাংকিং একটি শ্বাসত পদ্ধতি। ইসলামি ব্যাংকিং পরিচালনায় আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো সমস্যা দেখছি না। কোনো একটা বিষয় বা সমস্যা ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থার ত্রুটি ভাবা সংকীর্ণতা হবে। সমস্যা আসবে, উত্তরণও হবে ইনশাল্লাহ ।

শেয়ার বিজ: সার্বিকভাবে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যৎ কী দেখছেন?

জাফর আলম: এদেশে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যৎ খুবই ভালো। পদ্ধতিগতভাবে শ্রেষ্ঠতর, সাধারণ মানুষের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য হওয়ায় ইসলামি ব্যাংকিং আরও সম্প্রসারিত হবে। অনেক ব্যাংকতো পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকিং করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন দিয়ে রেখেছে। আগামী দিনে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের মার্কেট শেয়ার বাড়বে এটাই আমার দৃঢ় প্রত্যাশা।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রোহান রাজীব

ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড