মো. রাহাতুল ইসলাম : ইসলামী ইন্সুরেন্স বাংলাদেশ লিমিটেডের ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হওয়া অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি আর্থিক অসঙ্গতির বিষয় ওঠে এসেছে। প্রিমিয়াম আয়ের ভিন্নতা, ব্যাংক হিসাবের সঙ্গে মিল না থাকা এবং প্রভিডেন্ট ফান্ড সংক্রান্ত অস্পষ্টতাÑ এসব ইঙ্গিত দেয় আর্থিক প্রতিবেদন প্রণয়নে ঘাটতির দিকে। যদিও নিরীক্ষকরা মতামতে সংশোধনী দেননি, তবে বিষয়গুলো বিনিয়োগকারীদের জন্য সতর্ক সংকেত হতে পারে।
ইসলামী ইন্স্যুরেন্স বাংলাদেশ পিএলসির ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হওয়া অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে একাধিক আর্থিক অসঙ্গতির বিষয়ে নিরীক্ষকরা আলাদা করে উল্লেখ করেছেন। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোম্পানির ভ্যাট রিটার্ন অনুযায়ী মোট প্রিমিয়াম দেখানো হয়েছে ৫৯ কোটি ১৯ লাখ টাকা, অথচ আর্থিক বিবরণীর ‘এক্সএল ফর্ম’-এ এটি দেখানো হয়েছে ৫৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এ দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান ১ কোটি টাকার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নিরীক্ষক দলকে কোম্পানি দিতে পারেনি।
এছাড়া কোম্পানির ব্যাংক হিসাব অনুযায়ী প্রিমিয়াম সংগ্রহের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৬৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, যা পূর্বোক্ত তথ্যের সঙ্গে মিলছে না। নিরীক্ষক দল আরও জানিয়েছে, কোম্পানির প্রভিডেন্ট ফান্ডে বাজেয়াপ্ত অর্থের পরিমাণ নির্ধারণ করা যায়নি, কারণ সংশ্লিষ্ট নিরীক্ষা প্রতিবেদন কোম্পানির কাছে ছিল না।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, কোম্পানিটি করপূর্ব নিট মুনাফার ৫ শতাংশ হারে ১ কোটি ৮১ লাখ টাকা উৎসাহ বোনাস হিসেবে বরাদ্দ রেখেছে, যা কর্মীদের এক মাসের মূল বেতনের সমান। তবে শ্রমিকদের মুনাফা অংশগ্রহণ তহবিল (ডাব্লিউপিপিএফ) গঠনের বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। এ বিষয়ে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে বিষয়টি বিবেচনাধীন রয়েছে।
তবে উল্লিখিত বিষয়গুলোর কারণে নিরীক্ষকরা তাদের মতামতে কোনো ধরনের সংশোধনী বা আপত্তি দেননি। তবে এই প্রতিবেদনটি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি সতর্ক সংকেত হিসেবে বিবেচিত। কারণ এতে কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন প্রণয়নে কিছু ঘাটতির বিষয় ওঠে এসেছে।
এদিকে ডিএসইর সবশেষ তথ্যমতে, কোম্পানিটি ২০০৯ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে বর্তমানে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে অবস্থান করছে। ১০০ কোটি টাকার অনুমদিত মূলধনের বিপরীতে তাদের পরিশোধিত মূলধন ৪১ কোটি ১৬ লাখ টাকা। কোম্পানিটির রিজার্ভের পরিমাণ এক হাজার ৪৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত টানা তিন বছর তাদের কর পরবর্তী মুনাফা বেড়েছে। ২০১৯ সালে কোম্পানিটি মুনাফা করে ৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকা, যা ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৮ কোটি ১৫ লাখ টাকায় এবং ২০২১ সালে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১২ কোটি ৭৯ লাখ টাকায়। তবে ২০২২-২৩ সালে এসে তাদের কর পরবর্তী মুনাফা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ২০২২ সালে কোম্পানিটির মুনাফা কমে দাঁড়ায় ১২ কোটি ৬৩ লাখ টাকায়, যা ২০২৩ সালে আরও কমে দাঁড়ায় ১১ কোটি ৯২ লাখ টাকায়।
২০২৩ সালের বিনিয়োগকারীদের ১৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে কোম্পানিটি। আলোচিত সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ১৫ টাকা ৮৮ পয়সা, আর ২০২৩ সালের ৩০ জুন তারিখে শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ২০ টাকা ৮৭ পয়সা। এছাড়া ২০২২ সালের তারা বিনিয়োগকারীদের ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে কোম্পানিটি। আলোচিত সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ১২ টাকা ৭৭ পয়সা, আর ২০২২ সালের শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ১৯ টাকা ১৮ পয়সা।
ডিএসইর সূত্রে, কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মধ্যে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের কাছে ৪৫ দশমিক ৬১ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাছে ৪৫ দশমিক ৮২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
এদিকে গতকাল ডিএসইতে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ার ৩৭ টাকা ৫০ পয়সা দরে হাতবদল হয়, যার সমাপনী দর ছিল ৩৫ টাকা ৮০ পয়সা। দিনজুড়ে কোম্পানিটির শেয়ারদর সর্বনিম্ন ৩৫ টাকা ৭০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ৩৭ টাকায় ৫০ পয়সায় লেনদেন হয়। কোম্পানিটির মোট চার কোটি ১১ লাখ ৬৫ হাজার ২১৫টি শেয়ার রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বিমা খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশেষ করে যেসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়ে পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করে, তাদের আর্থিক প্রতিবেদনে এমন অসামঞ্জস্যতা নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকির অভাবকেও চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) এবং ডিএসইকে আরও কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে, যেন বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষিত থাকে এবং কোম্পানিগুলো সময়মতো নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রকাশে বাধ্য হয়।