ঈদের খুশি ছড়িয়ে পড়ুক সকল প্রাণে

কাজী সালমা সুলতানা: ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা দুটি ঈদ মুসলমানদের মধ্যে বড় উৎসব। এই দুই উৎসব পালনের মধ্যে রয়েছে দুই রকম তাৎপর্য। ঈদুল ফিতরে দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধানার মাধ্যমে মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধতা ঘটে। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর ঈদুল ফিতর সমাগত। ঈদের খুশিও আগমনী বার্তা জানান দিচ্ছে। পবিত্র রমজান মাস শুরু হওয়ার পর থেকেই ক্ষণগণনা শুরু হয় ঈদুল ফিতরের। তাই এই ঈদে আনন্দের মাত্রাটা একটু বাড়তি বোধ হয়। বিশ্বের সকল মুসলমানই এই পবিত্র দিনটির জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন আর সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেন। 

ঈদের আনন্দ ধর্মীয় আচারকে ছাপিয়ে সামাজিকতায় রূপ নেয়। তাই ঈদ এলেই দেখা দেয় পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও দরিদ্র মানুষের মধ্যে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়ার আয়োজন। শুরু হয় প্রিয়জনকে উপহার দেয়া এবং দরিদ্রদের সাধ্যমতো সাহায্য করার প্রস্তুতি। আর এ প্রস্তুতিও শুরু হয় পবিত্র রমজানের শুরু থেকেই। তাই একদিকে চলে ইবাদত, অন্যদিকে চলে নতুন পোশাক কেনাকাটা।

গত দুই বছর মহামারি কভিডে প্রাদুর্ভাবে ঈদের প্রকৃত আমেজ ফুটে ওঠেনি। অনেকেই পবিবারের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে পারেনি। সারাদেশে কভিডে আমরা অনেকেই আপনজন বা স্বজন হারিয়েছি। প্রতিদিনই ছিল আতঙ্কের, প্রতিদিনই ছিল মৃত্যের সংখ্যা গণনা। সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি অতিক্রম করে আবার এসেছে ঈদুল ফিতর। তাই এক ভিন্ন আবহ নিয়ে এসেছে এবারের ঈদুল ফিতর। ঈদকে কেন্দ্র করে সারাদেশে জমে উঠেছে ঈদের বাজার। ব্যবসায়ীরাও তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চেষ্টা করছে এবারের ঈদুল ফিতরে।

মানুষ তার সাধ্যমতো আয়োজনে ঈদুল ফিতরের দিনটি আনন্দঘন পরিবেশে উদযাপন করে থাকে। বাড়ির ছোটরা নতুন জামা কাপড়ে নিজেদের সাজিয়ে তুলতে মা-বাবার সঙ্গে কেনাকাটা করছে। সবাই নিজ নিজ সাধ্যমতো নতুন জামা কাপড় কিনছে, ঘর সাজানোসহ ঈদের দিনে অতিথি আপ্যায়নে রান্নার নতুন উপকরণ বা রেসেপি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

ঈদের আনন্দ পরিবারের নিকটজনের সঙ্গে ভাগ করে নিতে এক কোটির অধিক মানুষ এবার ঢাকা ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছে। যাত্রা পথের বিড়ম্বনা তাই অনেকটা বেড়েছে। ইতোমধ্যে ট্রেনের টিকিট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত রেল কর্মকর্তা আটক হয়েছে। লঞ্চ বাসের টিকিটের দাম যেন মালিক পক্ষ ইচ্ছামতো না বাড়াতে পারে সেই তদারকিও শুরু হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। সাপ্তাহিক ছুটি, মে দিবসসহ এবার ঈদে দীর্ঘ ছুটিতে পড়েছে দেশ। ৫ মে বৃহস্পতিবার একদিন অফিস খোলা। তাই অনেকেই ৯ দিন ছুটি কাটিয়েই কাজে ফিরবে। এ কারণেও ঢাকা ছাড়ছে বেশি মানুষ।

গ্রীষ্মের উত্তাপ এবার বেশি অনুভ‚ত হচ্ছে। ঢাকায় তাপমাত্রা কমাতে ছিটানো হচ্ছে পানি। যানজটের কারণে পথে নির্ধারিত সময় থেকে কয়েক ঘণ্টা সময় বেশি লাগছে। তবু সকল বাধা অতিক্রম করে সবাই ছুটে যাচ্ছেন স্বজনের কাছে। অনেকে দেশের বাইরে ঈদ উদযাপন করতে যাচ্ছে। দেশের ভেতরেও পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজারের লক্ষাধিক মানুষ ঈদের ছুটি কাটাতে যাচ্ছে। চারদিকে আনন্দের এক সাজ সাজ রব!  

দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর মুসলমানরা এই দিনটি ধর্মীয় কর্তব্যপালনসহ খুব আনন্দর সঙ্গে পালন করে থাকে। হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে রমজান মাসের শেষে শাওয়াল মাসের পহেলা তারিখে ঈদুল ফিতর উৎসব পালন করা হয়। এই পঞ্জিকা অনুসারে কোনো অবস্থাতে রমজান মাস ৩০ দিনের বেশি হয় না। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে রমজানের সমাপ্তিতে শাওয়ালের প্রারম্ভ গণনা করা হয়। বাংলাদেশে ঈদের দিন নির্ধারিত হয় চাঁদ দেখার ওপর ভিত্তি করে। জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে ঈদের দিন চ‚ড়ান্ত করা হয়।

ঈদের দিন ইসলামিক বিধান অনুসারে ২ রাকাত ঈদের নামাজ ৬ তাকবিরের সঙ্গে ময়দান বা মসজিদে আদায় করা হয়। ফজরের নামাজের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পর ঈদুল ফিতরের নামাজের সময় হয়। এই নামাজ আদায় করা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। ইমাম কর্তৃক শুক্রবারে জুমার নামাজের পূর্বে খুৎবা (ইসলামিক বক্তব্য) প্রদানের বিধান থাকলেও ঈদের নামাজের ক্ষেত্রে তা নামাজের পর প্রদান করার নিয়ম। ইসলামের বর্ণনা অনুযায়ী ঈদুল ফিতরের নামাজ শেষে খুৎবা প্রদান ইমামের জন্য সুন্নত; তা মনোযোগ দিয়ে শোনা নামাজির জন্য ওয়াজিব। 

ঈদের নামাজ আদায় করতে যাওয়ার আগে একটি খেজুর কিংবা খোরমা অথবা মিষ্টান্ন খেয়ে রওনা হওয়া সওয়াবের (পুণ্যের) কাজ। ঈদুল ফিতরের ব্যাপারে ইসলামি নির্দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে গোসল করা, মিসওয়াক করা, আতর-সুরমা লাগানো। 

ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের রমজান মাসের রোজার ভুলত্রæটি দূর করার জন্য ঈদের দিন অভাবী বা দুস্থদের কাছে অর্থ প্রদান করে, যেটিকে ফিতরা বলা হয়ে থাকে। এটি প্রদান করা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। ঈদের নামাজের আগেই ফিতরা আদায় করার বিধান রয়েছে। তবে ভুলক্রমে নামাজ পড়া হয়ে গেলেও ফিতরা আদায় করার নির্দেশ ইসলামে রয়েছে।

ইসলামের বিধান অনুযায়ী, জাকাত পাওয়ার যোগ্যরাই ফিতরা লাভের যোগ্য। কিন্তু দেখা যায় অনেকে জাকাত  দিতে গিয়ে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। একটা শাড়ি বা লুঙ্গির জন্য দরিদ্র মানুষ চাপাচাপিতে পড়ে জীবন পর্যন্ত চলে যায়। দেশে ধনী মানুষ বাড়ছে কিন্তু সে তুলনায় দরিদ্র মানুষদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে না। এতে স্পষ্টতই শ্রেণিভেদ প্রকট আকার ধারণ করছে। অথচ জাকাত ফেতরা যথাযথভাবে আদায় করলে মানুষে মানুষে বৈষম্য কমে আসত।

ঈদে যে আনন্দধারা প্রবাহিত হয়, পুণ্যতায়  পরিপূর্ণ। এ দিনে অনেক কাজ আছে; যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর নিকটবর্তী হতে পারি এবং ঈদ উদযাপনও একটি ইবাদতে পরিণত হতে পারে। কিন্তু দেখা যায় ঈদকে কেন্দ্র করে এক স্তরের মানুষ অপচয়ে মত্ত হয় যায়।  এদের দুর্নীতি এক দিনের জন্য থেমে থাকে না। সেই সঙ্গে তারা লোক দেখানো আত্মপ্রচারে বিভোর থাকে। অথচ পাশের বাড়ির মানুষটি না খেয়ে থাকলেও খবর রাখে না। রমজান মাসজুড়েও দেশে দেশে যুদ্ধবিগ্রহ চলছে। প্রতিদিন বহু মানুষ তাতে প্রাণ হারাচ্ছে। দেশেও হিংসা-মারামারি-হত্যা প্রতিদিন চলছে। মানুষের ধৈর্যশক্তি  হ্রাস পাচ্ছে। ধর্মপ্রাণ মানুষ থেকে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা সমাজে শান্তি নষ্ট করছে। মানুষে মানুষে দূরত্ব বাড়াছে।

তবুও চাই মানুষ মানুষের পাশে থাকুক উৎসবে, শোকে  মমতায়। ঈদ হোক সম্প্রীতির, ভ্রাতৃত্বের, সমতার। ভুলে যাক হবে সব বৈষম্য, সব ভেদাভেদ। হিংসা, বিদ্বেষ ও হানাহানি থেকে নিজেদের মুক্ত করুক। শান্তিপ্রিয়  মুসলমান হিসেবে সারাবিশ্বে মানুষের মর্যাদা ঊর্ধ্বে

তুলে ধরুক।

ঈদ মুসলমানদের জন্য শুধু একটি ধর্মীয় উৎসবই নয়, সম্প্রীতি-ভ্রাতৃত্ববোধ শেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ। শুধু মুসলমান নয়, অন্যান্য ধর্মের মানুষের সঙ্গেও আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। তাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাক ঈদের  আনন্দ। ঘরে ঘরে ফিরে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি। বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।

গণমাধ্যমকর্মী

salma15august@gmail.com