প্রতিনিধি, জাবি: প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর মনোমুগ্ধকর পরিবেশে ঘেরা শিক্ষাঙ্গন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীর হৃদয়ে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে ক্যাম্পাসের প্রতিটি পথ, প্রতিটি হলের আঙিনা, লেকের ধারে সন্ধ্যার আড্ডা, আর ক্লাসরুমের প্রাণবন্ত মুহূর্ত।
তবে, চঞ্চলতা, কোলাহল আর পদচারণায় মুখর থাকা ক্যাম্পাস ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। পবিত্র ইদুল ফিতরের ছুটিতে শিক্ষার্থীরা দলবেঁধে বাড়ি ফিরছেন, প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য। দীর্ঘ একাডেমিক ব্যস্ততার পর ঈদের ছুটি শিক্ষার্থীদের জন্য এক স্বস্তির বার্তা নিয়ে এসেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে ঈদের ছুটির আমেজ স্পষ্ট। হলের বারান্দা, ক্যাম্পাসের ক্যাফেটেরিয়া কিংবা লাইব্রেরির সামনে যেখানে প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের আড্ডা জমে উঠত, সেখানে এখন নিরবতা। বাস, ট্রেন আর লঞ্চ যাত্রার জন্য ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দেওয়ার তাড়া—সব মিলিয়ে উৎসবের আবহ।
ঈদ মানেই পরিবার, প্রিয়জন, আর শৈশবের স্মৃতির সঙ্গে নতুন করে মিশে যাওয়া। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ঈদের ছুটি একদিকে যেমন আনন্দ বয়ে আনে, তেমনই ক্যাম্পাস থেকে বিদায়ের একটি বিষণ্নতাও থাকে। প্রতিবারের মতো এবারও ঈদের ছুটি ঘিরে শিক্ষার্থীদের মাঝে বাড়ি ফেরার উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন বিভাগের ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট ও পরীক্ষার চাপে অনেকদিন পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ হয়নি অনেকেরই। তাই ঈদ মানেই তাদের কাছে শুধুই আনন্দ নয়, বরং স্বজনদের কাছে ফিরে যাওয়ার এক দুর্লভ সুযোগ।
আইন ও বিচার বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রওনক তাসনীম বলেন, ক্যাম্পাস আমার দ্বিতীয় বাড়ি। এখানে বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তই দারুণ আনন্দের। কিন্তু ঈদের ছুটিতে বাসায় ফেরার সময় এক অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করে—একদিকে বাড়ি ফেরার আনন্দ, অন্যদিকে প্রিয় জায়গা ছেড়ে যাওয়ার একধরনের খালি লাগা।
শিক্ষার্থীদের বাড়ি ফেরার কারণে প্রতিটি আবাসিক হল এখন অনেকটাই ফাঁকা। ক্যান্টিন, গেটে বসা চায়ের দোকানগুলোতেও নেই সেই চিরচেনা ভিড়। হলগুলোর করিডোরে পা পড়লেই বোঝা যায়, এখানে একসময় কত প্রাণের স্পন্দন ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কর্মী আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা অভ্যস্ত ক্যাম্পাসের চঞ্চলতায়। ছুটি এলেই ক্যাম্পাস ফাঁকা হয়ে যায়, তখন যেন কিছুটা অন্যরকম লাগে। তবে এটাই নিয়ম। কিছুদিন পর আবার শিক্ষার্থীরা ফিরবে, ক্যাম্পাস প্রাণ ফিরে পাবে।
তবে সবাই যে বাড়ি ফিরছে তা নয়। অনেক শিক্ষার্থী নানা কারণে হলে থেকে যাচ্ছেন। কেউ কেউ গবেষণা, চাকরির প্রস্তুতি কিংবা ব্যক্তিগত কাজের জন্য হলে অবস্থান করছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং এটি একটি অনুভূতির নাম। হলের রাতজাগা গল্প, গানের আসর, আর ক্লাসের ব্যস্ততা যখন ঈদের ছুটির জন্য থেমে যায়, তখন পুরো ক্যাম্পাস যেন একটু ফাঁকা হয়ে যায়। এই নিস্তব্ধতা শিক্ষার্থীদের মনেও দাগ কাটে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ, লেকের ধারে হাঁটা, খেলার মাঠে বিকেলের ব্যস্ততা—এসব কিছুই একসময় অভ্যাসে পরিণত হয়। ফলে ঈদের ছুটিতে ক্যাম্পাস ছেড়ে যাওয়া মানেই এসব অভ্যাস থেকে সাময়িক বিচ্ছেদ। বিশেষ করে হলের আবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য বিষয়টি আরও আবেগঘন হয়ে ওঠে।
তবে ক্যাম্পাস ছাড়ার দুঃখের মাঝেও থাকে ঈদের আনন্দ। অনেকদিন পর পরিবারের সঙ্গে দেখা হওয়ার উচ্ছ্বাস, মায়ের হাতের রান্না খাওয়ার অপেক্ষা, ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার পরিকল্পনা—এসব ভাবনা শিক্ষার্থীদের মনকে উজ্জীবিত করে।
ইমরান হোসাইন শুভ বলেন, আমার বাড়ি খুলনায়। প্রতি ঈদে বাসে করে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হয়, কিন্তু ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয় পরিবার ও আপনজনদের সঙ্গে কাটানো মুহূর্ত।
সারাবছর পড়াশোনার চাপে ব্যস্ত থাকলেও ঈদের ছুটিতে শিক্ষার্থীরা পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পান। বাড়িতে গিয়েই তারা ছোটবেলার ঈদের স্মৃতি রোমন্থন করেন, বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যান এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করেন।
ছুটির পর শিক্ষার্থীরা আবার ফিরে আসবেন তাদের প্রিয় ক্যাম্পাসে। নতুন সেমিস্টার, নতুন ক্লাস, নতুন চ্যালেঞ্জ—সবকিছুই তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তবে ফেরার দিনটাও হয় অন্যরকম আনন্দের। বন্ধুরা একে অপরকে ঈদের অভিজ্ঞতা শোনাবে, ক্যাম্পাসের চেনা পরিবেশে আবার প্রাণ ফিরে আসবে। ধীরে ধীরে ক্যাম্পাসে ফিরতে শুরু করবেন শিক্ষার্থীরা। হলের বারান্দায় আবারও ভিড় জমবে, ক্যান্টিনে বসবে আড্ডা, লাইব্রেরিতে চলবে পড়াশোনার ব্যস্ততা। কিন্তু আপাতত, ক্যাম্পাস যেন অপেক্ষায় আছে তার প্রিয় শিক্ষার্থীদের ফেরার জন্য।