ঈর্ষা মানসিক অসুস্থতা বাড়ায়

রোকাইয়া আক্তার তিথি: মানসিক সুস্থতা, আমরা তো সবাই শারীরিকভাবে সুস্থ কিনাÑএসব বিষয় নিয়ে অনেক সচেতন এবং গুরুত্বের সঙ্গে দেখি শারীরিক অসুস্থতার প্রতিটি বিষয়কে। কিন্তু মানসিক সুস্থতা আমরা কি একটিবার ও আমাদের মানসিক সুস্থতার খবর রাখি

আমাদের মধ্যে বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতিযোগিতা মূলক বিষয়, অন্যের সঙ্গে তুলনা এই বিষয়গুলো অনেক বেশি মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলছে। পাওয়া না পাওয়ার হিসাব কষতে গিয়ে জীবনকে হারিয়ে ফেলছে। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, সব কিছু রেখে তুলনা বা প্রতিযোগিতা কেন?

তাহলে ধাপে ধাপে, বিষয়টি নিয়ে এগোনে যাক!

আমরা কিন্তু নিজে থেকে কেউ কারোর সঙ্গে তুলনা করি না, কাউকে দেখে ঈর্ষান্বিত হয় না, এই তুলনা ভাবনা বিষয়টি আমাদের মধ্যে তৈরি করে দেয়া হয় পরিপার্শ্বিক অবস্থান থেকে। প্রশ্ন জাগতে পারে, কীভাবে সম্ভব? আমরা যদি দুটো শিশুর কথা বলি, মনে করা যাক, দুটি শিশু একজন অনেক চঞ্চল দুষ্টু আরেকজন শান্ত। দুষ্টু শিশুটি অনেক দুষ্টুমি করে অবাধ্য কথা না শুনলে তখন প্রতিবেশী, আত্মীয় বা পরিবারের লোক বা যেকোনো ব্যক্তি বলে উঠে শিশুটি বড় হয়ে ভালো মানুষ হতে পারবে না, কেন না সে দুষ্টু, তার দ্বারা কিছু সম্ভব না, মা-বাবাকে কোনো দিন সম্মান করবে না। কিন্তু একই সঙ্গে শান্ত শিশুকে উদ্দেশ্য করে তুলনা করবে, যে অন্য শিশু অনেক ভদ্র, তার মতো হতে পারেনি, অন্য বাচ্চার থেকে ভালো না অনেক খারাপ। এরকম আরও অনেক কথা। এখন যে এই ভবিষ্যদ্বাণী প্রদান করল, তিনি কি ভবিষ্যৎ থেকে ভ্রমণ করে এসে এত নিশ্চিতভাবে বলতে পারেন, কে কী হবে, কার দ্বারা কী সম্ভব, কী সম্ভব নয়! এটি তো মোটেও ভালো তিনি করেননি। বরং মধ্য থেকে একটি শিশুর সঙ্গে আরেকজনের তুলনা করলেন, উদাহরণ টানলেন; ফলস্বরূপ শিশুদের মধ্যে একটি ভাবনা কাজ করবে, শিশু ভাববে, ওই তো অনেক বাজে, তার কাছে ওপর শিশুটি হীন মনে হবে। ওপর শিশুর মনেও ভাবনা আসবে, সব সময় তাকে কেন ভালো বলা হবে। এভাবে আস্তে আস্তে রেষারেষি সৃষ্টি হবে। সৃষ্টি হবে মানসিক অসুস্থতা। নোংরা প্রতিযোগিতা একজনের থেকে অন্যজনের ভালো করার প্রতিযোগিতা। কিন্তু এই প্রতিযোগিতার পুরস্কারস্বরূপ মানসিকভাবে কেউ ভালো থাকবে না। সর্বদা, একটি চিন্তা কাজ করবে, অন্যর থেকে কীভাবে ভালো করা যায়! জীবনে অশান্তি তে থাকতে এর থেকে বড় চিন্তা কি আর কিছু আছে? সব পেয়েও তখন আমরা সন্তুষ্ট থাকতে পারি না, নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট স্যাটিসফাইড নই।

আমরা কিন্তু সব সময় অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করি, কখনও নিজের সঙ্গে না। অন্যের থেকে কীভাবে ভালো করা যায় এসব ভাবি কিন্তু নিজেকে কীভাবে বর্তমান আমি থেকে আরও বেশি ভালো করা যায় এসব ভাবি না। সময়ের পরিক্রমায় আমরা এই ভালো করার চেষ্টায় মানুষ থেকে অমানুষে পরিণত হতে থাকি। 

সব ক্ষেত্রে আমরা তুলনা করতে পছন্দ করি, অন্যের থেকে নিজেকে কতটা উচ্চ আসনে রাখা যায় তার হিসাব করি, এসব করে যেন পৈশাচিক আনন্দ মেলে, তবে কি আমরা মানসিকভাবে অসুস্থ? নয়তো এমন আনন্দ তো হওয়ার কথা নয়। রেজাল্ট, চাকরি, পড়াশোনা, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা বলি, অমুক এই কাজটি করেছে আমিও করব। আমরা কেন নিজেকে অন্যভাবে ভাবতে পারি না? গতানুগতিকভাবে নিজেদের পরিচালিত করি? না কি আমাদের কে পরিচালিত করা হয়? কথাটি যদিও ভুল বলা যায় না। কারণ আমাদের আত্মীয়স্বজনসহ কিছু শুভাকাক্সক্ষী ব্যক্তি বর্গ এমন কাজটিই করে থাকেন। আমার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হতে পারল, আপনার ছেলে কেন পারল না? সবাই যদি ইঞ্জিনিয়ার হয় তাহলে কি চলবে? ব্যক্তি পছন্দ, ভাগ্য, পরিশ্রম, অভিরুচি নামক শব্দগুলো কেন জানি আমরা এসব ক্ষেত্রে ভুলে যায়। শিক্ষা-পরবর্তী জীবন যে খুব সুখকর তুলনা ছাড়া এমন কিন্তু নয়, সেখানেও চাকরির পজিশন, কে কী করছে কোথায় আছে, তাদের ছেলেমেয়েকে কেমন ভালো, কার থেকে কার ছেলেমেয়ে বেশি ভালো, এসব ভেবে ভেবে সেখানেও আবার সেই প্রতিযোগিতার সূচনা ঘটানোর কাজ চলতে থাকে।

যেখানে হিংসা বা অন্যের কোনো কিছু দেখে নিজের না পাওয়া নিয়ে আফসোস করা। এসব কি আদৌ যুক্তিযুক্ত কোনো কাজ! আমরা কেন নিজেদের নিয়ে নিজেদের বর্তমান অবস্থান নিয়ে খুশি থাকতে পারি না? না কি আমরা খুশি থাকতে চায় না? এসব ভাবনা হতাশাতে কি কোনো সমাধান রয়েছে? শুধুই তো নিজেদের মানসিক অসুস্থতা বৃদ্ধি করা।

এরপরে যখন আমরা অন্যের সঙ্গে তুলনা করতে করতে ক্লান্ত, তখন আমরা ভাবি আমাদের দিয়ে কিছু হবে না, জীবন বৃথা। অথবা আরেকটি বিষয় উঠে আসে তা হলো আমি কী করব? আমার কী করা উচিৎ? আমার সঙ্গে আগে কী ঘটেছেÑএখন কী ঘটছে? এসব ভাবতে ভাবতে আমরা বর্তমানকে নষ্ট করছি। যতটা সময় ধরে আমরা এই পাওয়া না পাওয়ার হিসাব মিলিয়ে যাচ্ছি ততটা সময় পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করে আগামী ভালো করতে পারি। কিন্তু না আমরা তো করব না। আমাদের তো পুরোনো সবকিছু ভেবে মানসিক চাপ নিতে অনেক বেশি ভালো লাগে। আমাদের তো ইচ্ছে শক্তি আমরা নিজেরাই দমন করছি। এখানে অন্য কোনো সহায়কের প্রয়োগ ঘটানোর প্রয়োজন হয় না। আমরা নিজেদের লক্ষ্য পূরণ করতে না পারলে লক্ষ্য থেকে সরে আসি; যা করা আমাদের উচিত নয়। এজন্য হয়তো চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছেন, কোনো লক্ষ্য অর্জন করা অসম্ভব মনে হলেও লক্ষ্য বদল করবে না, বরং কৌশল বদলে ফেলো”কিন্তু আমরা নিজেদের বদলে ফেলে হতাশায় নিমজ্জিত হই। আমাদের উচিত নিজেকে বিশ্বাস করা, নিজের কাজের ওপর আত্মবিশ্বাসী হওয়া।

আমরা অল্পতে কোনো কিছু না পেয়ে হতাশায় ডুবে যাওয়া কে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকি। আমাদের মনে হয় না, আমরা কেমন স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি? শুধু ওপরের থেকে সাহায্য নিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছি। কিন্তু অন্য কাউকে এগোতে সাহায্য করছি না বরং কীভাবে তাকে প্রতিহত করা যায়। হতে পারে শারীরিকভাবে, হতে পরে মানসিকভাবে, সেই চেষ্টা করছি। কিন্তু অন্যকে সাহায্য করার মধ্যে যে সুখ আত্মপ্রশান্তি লুকিয়ে আছে তা উপভোগ করছি না। এগুলো কিন্তু মানসিক খোরাক জোগায়, কিন্তু আমরা এগুলো থেকে দূরে। তবে সুস্থ হবো কীভাবে? আমরা ছোটখাটো সব বিষয়ে অন্যর ভুল ধরতে ব্যস্ত, কিন্তু নিজের ভুলগুলো সংশোধন করতে তৎপর না। তাহলে আমাদের উন্নতি ঘটবে কেমন করে!

প্রশ্ন জাগে, তাহলে পরিত্রাণের উপায়?

“ সর্বাঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দিবো কোথা”

আমাদের ক্ষেত্রেও বিষয়টি এমন। আমাদের মধ্যে এই অসুস্থতা সর্বাঙ্গে সর্বজনের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। এত সহজে পরিত্রাণ সম্ভব নয়। তবে আমরা চাইলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে পারি। নিজেদের নিয়ে খুশি থাকতে পারি। অন্যর সঙ্গে প্রতিযোগিতা না করে নিজেকে নিজের প্রতিযোগী হিসেবে গণ্য করতে পারি। কে কী বলল এসব বিষয়ে গুরুত্ব না দিয়ে নিজেকে নিজের মতো করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। হতাশাকে প্রাধান্য দেয়া যাবে না, ধর্মীয় চর্চা করতে হবে। প্রতিটি ধর্মই অহিংসার নীতি শেখায়, আমরা আমাদের কে তদ্রুপ পথে পরিচালিত করতে পারলে মন ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকব। পরিশেষে নিজ নিজ অবস্থান থেকে চেষ্টা করতে হবে যেন এমন অহেতুক মানসিক বিকারগ্রস্ততা যেন প্রাধান্য না পায়। একটি সুখী অহিংস সমাজের প্রত্যাশা করি।

শিক্ষার্থী

ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়