এম তাওহিদ হোসেন: মাতৃভাষায় নিজের মনের অভিব্যক্তি প্রকাশে যে আনন্দ, যে ভালোলাগা কাজ করে, সেটি পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষার বেলায় কাজ করে না। নিজ মাতৃভাষায় চিন্তার ও বিবেকের আত্মপ্রকাশ যত সহজে ঘটানো যায়, পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় সেটি যায় না। মাতৃভাষা যেমন সুর, সাহিত্য ও ভালোবাসায় মোড়ানো মহাকাব্য, ঠিক তেমনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে বর্জ্যধ্বনি হয়ে ওঠার অমোঘ হাতিয়ার। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের দ্বারা দীর্ঘ ১৯০ বছর শোষিত হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হয়ে যখন আলাদা দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়, তখন পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের শাসকেরা অন্যায়ভাবে পূর্ব পাকিস্তানের (তৎকালীন পূর্ব বাংলা) মানুষদের মায়ের মুখের ভাষা জোরপূর্বকভাবে কেড়ে নিতে চেয়েছিল, কারণ তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের শোষণের প্রাথমিক উপায় হচ্ছে মায়ের মুখের ভাষা কেড়ে নেয়া। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা বুঝতে পেরেছিল, মাতৃভাষা কেড়ে নেয়ার মাধ্যমে একটি জাতির অধিকার হরণ করা যায়, বিকাশ ও সমৃদ্ধির পথকে রূদ্ধ করা যায়, শিল্প-সাহিত্য ও ইতিহাসকে বিশ্ব মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা যায়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলেও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা তৎকালীন পূর্ব বাংলার মানুষের মাতৃভাষা কেড়ে নেয়ার জন্য নানামুখী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে প্রকাশ্যে ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রদের সভায় ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ এই মর্মে ঘোষণা দেন। পরবর্তী সময় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, সে প্রশ্নে তৎকালীন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনও গণপরিষদে প্রকাশ্যে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের অন্যায় এ আবদারের সঙ্গে আপস না করে তৎকালীন পূর্ব বাংলার জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। নিজ মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিতে তমুদ্দীন মজলিস ও সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে গণআন্দোলন শুরু হয়। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের জারি করা ১৪৪ ধারা এবং বন্দুকের গুলি উপেক্ষা করে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউরসহ নাম না জানা আরও দুই লাখ প্রাণ মাতৃভাষা রক্ষার জন্য আত্মদান করে। ভাষাশহিদদের রক্তকে ভয় করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা ১৯৫৪ সালে গণপরিষদে এবং ১৯৫৬ সালে সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এ বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পূর্ণ হবে। দুঃখজনক সত্য, আমাদের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বাংলা মাধ্যমে পড়ালেখা ও শেখার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে বাংলা ভাষায় লেখা বই এবং বাংলা ভাষায় পাঠদান করা হলেও উচ্চশিক্ষায় বিশেষ করে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পাঠদান ও শিখনে বাংলা ভাষার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারিনি। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেড় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগে পুরোদস্তুরভাবে ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদান করা হচ্ছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিজ্ঞান ও ব্যবসায় অনুষদের বিষয়ভিত্তিক বইগুলো ইংরেজিতে লেখা, সেইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম এবং পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন ইংরেজি মাধ্যমে হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা নানা বিড়ম্বনা মাথায় নিয়ে বাধ্য হয়েই পড়াশোনা করছে। ভিন্ন একটি ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশের শুরুতেই অসংখ্য শিক্ষার্থী পড়াশোনা ছেড়ে দিচ্ছে, অনেকেই পরীক্ষার উত্তরপত্রে ভিন্ন ভাষায় (মূলত ইংরেজি) লেখার কারণে নম্বর কম পাচ্ছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কলা অনুষদে কিছু বিষয় বাংলা মাধ্যমে পড়ানো হলেও সামাজিক বিজ্ঞান এবং আইন অনুষদে ঠিকই শিক্ষার্থীদের ওপর ইংরেজির খড়্গ চাপানো হচ্ছে। বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষায় পাঠদান ও শিখনে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা আরও ভয়াবহ। দেশে শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পাঠদান কার্যক্রম চালাচ্ছে। আর এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শতভাগ ইংরেজি পাঠক্রমে পড়ানো হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগ অনুষদ, বিভাগ ও বিষয় পদ্ধতিগত হওয়ায় ইংরেজি ভাষায় লেখা বই শিক্ষার্থীদের পড়তে হচ্ছে এবং শিক্ষকদেরও পড়াতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে চাকরির বাজারে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের টিকিয়ে রাখার জন্য এবং বেশি করিতকর্মা হিসেবে উপস্থাপনের জন্য ইংরেজিতে পাঠগ্রহণে বাধ্য করা হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অ্যাসাইনমেন্ট, কুইজ, প্রেজেন্টেশন, পরীক্ষার উত্তরপত্রসহ সর্বত্র ইংরেজি ভাষার প্রয়োগ ঘটানো হচ্ছে। ঢাকা শহরের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অবস্থানকালে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে কথা না বললে মহাঅপরাধ করেছে বলে পরিগণিত করা হয়। আর যেসব বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকার বাইরে, সে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোনো কারণে জোরপূর্বকভাবে পরীক্ষার উত্তরপত্রে ইংরেজিতে লিখতে বাধ্য করছে। অথচ ইউজিসি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে স্বাধীন ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ শীর্ষক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে সেটি বাংলা ভাষায় পাঠদান এবং উত্তরপত্রে শিক্ষার্থীদের বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করার কথা বলেছে। এ নির্দেশনা উপেক্ষা করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদান করছে এবং শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে উত্তরপত্র লিখতে বাধ্য করছে। দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বাংলা ভাষা ব্যবহারের এই উপেক্ষা শুধু প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষকদের নয়। এই উপেক্ষা, এই দায় রাষ্ট্রের, সরকারের। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা যে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র পেয়েছি, সেই রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, অথচ ভাষা আন্দোলনের ৭২ বছরে পদার্পণ করার পথে থাকলেও আমাদের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বাংলা ভাষা উপেক্ষিত। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দিলেও দেশের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারিদের বাংলা ভাষায় বিমুখ করা হচ্ছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূল দলিল সংবিধান ব্যাখ্যায় ১৫৩ অনুচ্ছেদবলে বাংলা ভাষা প্রাধ্যান্য পাবে বলে বলা হলেও আমাদের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাংলা ভাষায় পাঠদান উপেক্ষা করছে। ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭’ করা হলেও কৌশলে সেই আইনে স্পষ্ট করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা উহ্য করে রাখা হয়েছে, অথচ সেটিই আগে উল্লেখ করা দরকার ছিল। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্সসহ উন্নত বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্র নিজ মাতৃভাষায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এমনকি স্নাতকোত্তর পর্যায়েও মাতৃভাষায় পাঠদান পদ্ধতির প্রচলন অক্ষুণ্ন রেখেছে। তত্ত্বীয় ও পদ্ধতিগত নানা বিষয় এবং বই বিভিন্ন ভাষায় লেখা থাকলেও নিজ দেশের শিক্ষার্থীদের সহজবোধ্যভাবে বোধগম্য করার জন্য অনুবাদক দিয়ে অনুবাদ করিয়ে নিয়েছে। নিজ মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে তাদের শেখা এবং জানাকে টেকসইভাবে রূপান্তর করে টেকসই জাতি নির্মাণে অগ্রসর হচ্ছে। জাতিকে টেকসইভাবে গড়ার জন্য উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষার নিরঙ্কুশ প্রচলনের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারেÑ
এক. ইংরেজি ভাষার বই বাংলায় সহজবোধ্য এবং মান অক্ষুণ্ন রেখে অনুবাদ করা; দুই. দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বাংলা ভাষা শিক্ষা প্রশিক্ষায়তন (ইনস্টিটিউট) প্রতিষ্ঠা করা এবং সেখানে বাংলা ভাষার মানোন্নয়ন ও নির্ভুল অনুবাদ নিয়ে গবেষণা করা; তিন. বাংলা একাডেমিকে সব ধরনের স্বার্থ ও রাজনীতির ঊর্ধ্বে রেখে স্বাধীনভাবে দেশের নেতৃত্বস্থানীয় বাংলা ভাষা গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে রূপান্তর করা; চার. আর্থিক প্রণোদনা ও সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে অনুবাদক ও ভাষাবিদদের সহযোগিতা করা; পাঁচ. উন্নত বিশ্ব যেমন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজ নিজ মাতৃভাষার প্রচলন করে তাদের ভাষাকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরছে, আমরাও উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমাদের বাংলা ভাষাকে সার্বজনীন করে বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে পারি।
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষার্থী