উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাবে বাড়ছে অর্থনৈতিক ক্ষতি

রেজাউল করিম খোকন: তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে শ্রম উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে বাংলাদেশ। শুধু ঢাকা শহরে বছরে ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৬০০ কোটি ডলার।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দ্য রকফেলার ফাউন্ডেশন ও অ্যাড্রিয়েন আরশটের যৌথ গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা ঢাকা শহরের আবহাওয়াকে বিপজ্জনক করে তুলেছে। এ কারণে ঢাকার মানুষের উৎপাদনক্ষমতা কমছে। বাড়ছে অর্থনৈতিক ক্ষতি। উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার কারণে ঢাকা প্রতিবছর প্রায় ৬০০ কোটি ডলারের শ্রম উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে, যা ঢাকার বার্ষিক শ্রম উৎপাদনের আট শতাংশের বেশি। ‘হট সিটিস, চিলড ইকোনমিস: ইমপ্যাক্টস অব এক্সট্রিম হিট অন গ্লোবাল সিটিস’ শিরোনামের প্রতিবেদনটিতে ঢাকাসহ বিশ্বের ১২টি শহরে চরম তাপের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব মূল্যায়ন করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, উচ্চতাপের কারণে অন্য যেকোনো শহরের তুলনায় ঢাকার মানুষের শ্রম উৎপাদনশীলতা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাপমাত্রা কমাতে উদ্যোগ না নিলে ২০৫০ সাল নাগাদ এই ক্ষতি ১০ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। একাধিক প্রতিবেদনে ঢাকার তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়াসহ তপ্ত দ্বীপ এলাকা সম্প্রসারণের চিত্র উঠে এসেছে, যেখানে তাপমাত্রা কেন্দ্রীভূত হয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। তাপমাত্রা কমানোর জন্য শহরে জলাভূমি রক্ষা, সবুজ গাছপালার সংখ্যা বাড়ানো এবং বায়ুপ্রবাহের জন্য পরিকল্পিত নগরায়ণ না করলে এই ক্ষতি সামনের দিনে আরও বাড়বে। ঢাকা ছাড়া বাকি ১১টি শহর হলোÑএথেন্স (গ্রিস), ব্যাংকক (থাইল্যান্ড), বুয়েন্স এইরেস (আর্জেন্টিনা), ফ্রিটাউন (সিয়েরা লিওন), লন্ডন (যুক্তরাজ্য), লস অ্যাঞ্জেলস (যুক্তরাষ্ট্র), মিয়ামি (যুক্তরাষ্ট্র), মন্টেরেই (মেক্সিকো), নয়াদিল্লি (ভারত), সান্তিয়াগো (চিলি) ও সিডনি (অস্ট্রেলিয়া)। ১২টি শহরে ২০২০ সালে মোট ক্ষতির পরিমাণ চার হাজার ৪০০ কোটি ডলার। তাপমাত্রা কমাতে ব্যবস্থা না নিলে ২০৫০ সাল নাগাদ এই ক্ষতির পরিমাণ আট হাজার ৪০০ কোটি ডলার হতে পারে। ঢাকা শহরের ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ এলাকা এরই মধ্যে উচ্চ তাপমাত্রা-আর্দ্রতার আওতায় এসে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলবে। ঢাকার তাপ তার নগরকেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত। বসবাসের এই ধরনের পরিস্থিতি ঢাকাবাসীর উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। ঢাকায় শ্রমনিবিড় অর্থনৈতিক তৎপরতা বেশি। তাপমাত্রা কমানোর ব্যবস্থা এখানে কম। ফলে ঢাকা উচ্চতাপের প্রভাবের জন্য অস্বাভাবিক ঝুঁকিপূর্ণ। নি¤œ আয়ের কর্মীরা বিশেষভাবে উচ্চতাপের সংস্পর্শে আসে। তারা অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রভাবিত হয়। অনিয়ন্ত্রিত উষ্ণায়নের কারণে তৈরি পোশাক, পরিবহন ও খুচরা ব্যবসা খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ঢাকা শহরে প্রায় চার লাখ হকার রয়েছেন, যাদের বড় অংশ গ্রাম থেকে শহরে এসেছেন। শ্রমিক হিসেবে তাদের দক্ষতা কম। বেশিরভাগ হকারের কোনো স্থায়ী দোকান নেই। তারা মূলত ফুটপাতে উš§ুক্ত স্থানে নানা ধরনের পণ্য বিক্রি করেন। তাপপ্রবাহ চলার সময় ৯ শতাংশ হকার ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ আয় হারান। আর প্রায় ২৫ শতাংশ হকার ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ আয় হারান।

গত কয়েক বছরে করোনার ভয়াবহ রূপ দেখেছে বিশ্ব। শেষের দিকে যোগ হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ দুইয়ের প্রভাবে সারা বিশ্ব আজ মূল্যস্ফীতি নামক অর্থনীতির চাপে পিষ্ট। সবারই তাই প্রত্যাশা ছিল, ঝঞ্ঝামুক্ত সমৃদ্ধ একটি বছর হবে ২০২৩ সাল। বছরের অর্ধেকের বেশি পার হলেও প্রত্যাশার পালে তেমন হাওয়া লাগেনি। মূল্যস্ফীতি এখনও সাধারণ মানুষের জন্য ভীতিকর। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বৈরী প্রভাব ও তাপপ্রবাহ। ইউএস ন্যাশনাল সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল প্রেডিকশনের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের ৩ জুলাই সোমবার ছিল বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে উষ্ণতম দিন। বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা নতুন রেকর্ড ১৭ দশমিক শূন্য ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে। আগের রেকর্ড ছিল ২০১৬ সালের আগস্টে ১৬ দশমিক ৯২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দক্ষিণ এশিয়াসহ ইউরোপের অনেক দেশের ওপর তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। ভারতের অনেক রাজ্য ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পুড়ছে। রাজধানী নয়াদিল্লিতে তাপমাত্রা ৪৭ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠেছে। পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের কিছু জায়গায় তাপমাত্রা ৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত রেকর্ড করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষও অসহ্য গরমে অতিষ্ঠ। এপ্রিলে রাজধানী ঢাকায় তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছিল, যা গত ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তার আগে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে সম্ভবত ২০২৩ সাল সবচেয়ে উষ্ণ বছর হিসেবে রেকর্ডভুক্ত হতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশিয়ার বিশাল অংশজুড়ে টানা তাপপ্রবাহ ও এলনিনো আবহাওয়া প্যাটার্নের প্রভাবে প্রশান্ত মহাসাগরের পানি উষ্ণ হয়েছে এবং আটলান্টিক মহাসাগরের তাপমাত্রা রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর আগে পৃথিবীর ইতিহাসে তাপমাত্রা বৃদ্ধির এমন রেকর্ড দেখা যায়নি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের জলবায়ু গবেষণা বিষয়ক সংস্থা বার্কলে আর্থ এক বিবৃতিতে এই আশঙ্কা জানিয়েছে। সংস্থাটির জলবায়ুবিজ্ঞানী জেক হাউসফাদার বলেছেন, আমরা ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে প্রতিমাসের বৈশ্বিক তাপমাত্রার রেকর্ড রাখছি। সম্প্রতি এই পরিসংখ্যানে বিশ্লেষণ করে আমরা জানতে পেরেছি, চলতি ২০২৩ সাল সম্ভবত মানবসভ্যতার উষ্ণতম বছর হতে চলেছে।

বিশ্বজুড়ে শিল্পকারখানাভিত্তিক উৎপাদন শুরু হয় ১৮৫০ সালের কিছু আগে থেকে। জাতিসংঘের জলবায়ু প্রতিবেদন অনুসারে, তার পর থেকে এ পর্যন্ত গত ১৭৩ বছরে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বার্কলে আর্থের এই বক্তব্যকে সমর্থন করেছে ফ্রান্সের জলবায়ু গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চ। বিজ্ঞানীরা গত ২০ বছর ধরেই এই আশঙ্কা করছেন। এই অবস্থার জন্য দায়ী মূলত আমরা। আমাদের বেপরোয়া শিল্পায়ন, বনজঙ্গল ধ্বংস ও লাগমহীন কার্বন নিঃসরণ বিশ্বকে আজ এই অবস্থায় দিকে ঠেলে দিয়েছে। গড় তাপমাত্রার এই পরিমাণ বৃদ্ধি এরই মধ্যে বিশ্বের জলবায়ুর ভারসাম্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং বিলুপ্তির ঝুঁকিতে ফেলেছে অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতিকে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য বছরের পর বছর ধরে অতিমাত্রায় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, বনাঞ্চল ধ্বংস এবং বাতাসে নিয়মিত স্বাভাবিকমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি হারে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণকে দায়ী করেছেন বিজ্ঞানীরা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জলবায়ুবিষয়ক বিশেষ দূত জন কেরি যখন চীন সফরে ছিলেন, চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে তাপমাত্রা তখন ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি। শীতপ্রধান ইউরোপে গরমে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। প্রাচীন গ্রিসের অ্যাক্রোপলিস শতাব্দী ধরে এথেন্স শহরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ হয়ে। তীব্র তাপপ্রবাহে দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় বন্ধ রাখতে হচ্ছে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণের এ কেন্দ্রবিন্দু। গ্রিসে অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে জুলাইয়ে সবচেয়ে উষ্ণতম দিন হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। স্প্যানিশ রাষ্ট্রীয় আবহাওয়া দপ্তর ধারণা করছে, জুলাইয়ে দেশটির তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছতে পারে। আফ্রিকাও এ ধারার ব্যতিক্রম নয়। উত্তর আফ্রিকায় উষ্ণতার পারদ উঠেছিল ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি এই জুলাইয়ে।

বিশ্বব্যাপী জুলাইয়ে গড় তাপমাত্রা এরই মধ্যে শিল্পপূর্ব স্তরের তুলনায় কমপক্ষে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। তবে তাপমাত্রার এ উল্লম্ফন ২০২৩ সালেই শেষ এমনটা নয়। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাবে তীব্র তাপপ্রবাহ আগামী দিনগুলোয় আরও ঘনঘন ঘটবে এবং এর প্রভাব পড়বে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ১৯৯২ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ২১ বছরে বিশ্ব অর্থনীতির আনুমানিক ১৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়েছে। ইউরোপের পর্যটনশিল্প এবার প্রত্যাশার চেয়ে কম পর্যটক পেয়েছে। ভূমধ্যসাগরের বিশাল পর্যটনশিল্প কতটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে শীতপ্রধান ইউরোপে ক্রমে সাধারণ হয়ে ওঠা তাপপ্রবাহ তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে তাপপ্রবাহের এ বৈরী প্রভাব কেবল পর্যটনশিল্পেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং নির্মাণশিল্প, শিল্পের উৎপাদন, কৃষি, পরিবহন ও বিমা সবই প্রভাবিত হচ্ছে। অর্থনীতির গতিশীলতাকে রুখে দিচ্ছে জলবায়ুর পরিবর্তন। যেমন, তীব্র তাপপ্রবাহে কর্মীরা দীর্ঘক্ষণ কাজ করতে পারেন না। আবার যতক্ষণ কাজ করেন, তাপপ্রবাহের কারণের কর্মীদের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়। তীব্র গরমে কাজ করা অতিশয় ঝুঁকিপূর্ণ, মানুষের চিন্তাশক্তি কমে, ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অরগানাইজেশন বা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা তাদের একটি গবেষণায় দেখায়, ২০৩০ সাল নাগাদ মোট কর্মঘণ্টার আনুমানিক দুই শতাংশ হ্রাস পাবে, হয় তীব্র গরমে কাজ করতে না পারার কারণে, অথবা খুব গরমে শ্রমিকদের কাজে ধীরগতির জন্য। বিশ্বের বিভিন্ন শহরে বর্তমানে কর্মরত প্রায় ২০ কোটি মানুষ চরম তাপদাহের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, যাদের সংখ্যা ২০৫০ সালের মধ্যে আটগুণ বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের অধিকাংশেরই অবস্থান উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশে। বিশেষ করে দরিদ্র ও প্রচণ্ড গরমে খাপ খাইয়ে নেয়ার কম ক্ষমতাসম্পন্ন জনগোষ্ঠী জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরী প্রভাবের সম্মুখীন হবে বেশি। যাদের নিয়মিত বাইরে কাজ করতে হয়, যেমন কৃষি বা নির্মাণ শ্রমিক, তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে তাদের দুর্ঘটনা, অসুস্থতা, কম উৎপাদনশীলতা, এমনকি মৃত্যুঝুঁকিও বেশি। তাপদাহের কারণে পৃথিবীজুড়ে যত মৃত্যু, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি নির্মাণশিল্পে। তবে যারা কারখানার অভ্যন্তরে কাজ করেন তারাও তাপদাহের ঝুঁকির বাইরে নন। যেমন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত সাড়ে ছয় কোটি টেক্সটাইল শ্রমিক, যারা প্রায়ই কোনো রকম শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছাড়াই কাজ করেন, তারা তীব্র তাপদাহে বিভিন্ন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। আবার তাদের অধিকাংশই এশিয়া মহাদেশে অবস্থিত, যেখানে তাপমাত্রা বেশ চরম ও বিপজ্জনক। শুধু তা-ই নয়, আগেরকার কারখানা ও গুদামঘরের ডিজাইন বর্তমানে বিরাজমান উচ্চ তাপমাত্রাকে মাথায় রেখে করা হয়নি। অধিকন্তু তাপমাত্রা যদি ভবিষ্যতে বাড়তেই থাকে, তবে অনেক কলকারখানা কর্মীর জন্য কাজ করার অনুপযোগী হয়ে পড়বে। অন্যদিকে কারখানার যন্ত্রপাতির কার্যকারিতা হ্রাস পাবে এবং তাদের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল কমে যাবে। কর্মীদের ওপর তাপপ্রবাহের প্রভাব অবশ্যই কোম্পানিগুলোকে আমলে নিতে হবে, কারণ কর্মীদের নিরাপত্তা মানবাধিকারের অংশ। তার বাইরেও কোম্পানিগুলোকে ভাবতে হবে ব্যবসায়িক কেন্দ্রগুলো কোথায় হবে এবং ব্যবসার ধরনে কী পরিবর্তন আনতে হবে তা নিয়ে। ঐতিহাসিকভাবে নদী বা বন্দরকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়িক কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, কারণ নদীপথে পণ্য পরিবহন খরচ তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনেক নদীপথ হয় ভরাট হয়ে গেছে, নতুবা নদীর পানি শুকিয়ে নদীপথকে পণ্য পরিবহনের অনুপযোগী করে তুলছে। বাংলাদেশের চলনবিল, বাঘাবাড়ী নৌবন্দর, এমনকি পদ্মার নাব্য হ্রাসে অনেক সময় পরিবহন সংকট দেখা দেয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ইংল্যান্ডের বিখ্যাত রাইন নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রবলভাবে। শুধু তা-ই নয়, কলকারখানা পরিচালনায় প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। উচ্চ তাপমাত্রায় পানির চাহিদা আরো বেড়ে যায়। এ অবস্থায় বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের পাশাপাশি পানির ক্রমাগত সরবরাহ শিল্পের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তবে নির্মাণকাজের জন্য দরকারি উপকরণ প্রস্তুতকারকদের ব্যবসায়িক মডেল নিয়ে ভাবতে হবে অনেক বেশি। অত্যধিক তাপমাত্রায় নির্মাণসামগ্রীর গুণগত মান হ্রাস পায়। যেমন উচ্চ তাপমাত্রায় ইস্পাত বেঁকে যেতে পারে এবং কংক্রিট দিয়ে কাজ করা দুরূহ হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ঢালাই কাজ সম্পন্ন করার সময় উচ্চ তাপমাত্রা নির্মাণকাজে ফাটলের সৃষ্টি করে। নির্মাণকাজে জটিলতায় মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেই এ-সংক্রান্ত মামলা ক্রমবর্ধমান হারে আদালতে গড়াচ্ছে। সুতরাং নির্মাণশিল্পের উপকরণ প্রস্তুতকারীদের নতুন করে ভাবতে হবে কীভাবে তাপসহিষ্ণু উপকরণ তৈরি করা যায়। এতে পণ্যের ব্যয় বৃদ্ধি, নির্মাণকাজে নতুন জটিলতাসহ নির্মাণকাজকে সময়সাপেক্ষ করে তুলবে। একই কথা প্রযোজ্য গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় তাপমাত্রা অনেক বেশি বলে কালো রঙের গাড়ি খুব কমই চোখে পড়ে, কেননা কালো রঙ বেশি তাপ শোষণ করে। তদুপরি মোটরযানের অভ্যন্তরীণ গঠন, টায়ারের প্রকৃতি ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শীতপ্রধান অঞ্চলের জন্য প্রস্তুতকৃত মোটরযানের চেয়ে কিছুটা আলাদা। সুতরাং অটোমোবাইল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে শুধু দূষণ কমালেই চলবে না, বরং জলবায়ু পরিবর্তন এবং তাপমাত্রার ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে কী ধরনের বস্তু বা উপাদানে গাড়ি প্রস্তুত করলে তা উচ্চ তাপীয় পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবে, তা নিয়েও ভাবতে হবে।

বিশ্বব্যাপী তাপপ্রবাহের বৈরী প্রভাব বেশি পরিলক্ষিত হবে কৃষি খাতে এবং কৃষিতে উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাব সহজেই দৃশ্যমান। যেমন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাপ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে। ২০১৮ সালে তীব্র তাপপ্রবাহের ফলে মধ্য ও উত্তর ইউরোপে প্রায় ৫০ শতাংশ ফসলের ক্ষতি হয়েছে। বিশ্বায়নের এ যুগে আমাদের খাদ্য ব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী জালের মতো ছড়ানো। যেমন বীজ উৎপাদন এবং সংরক্ষণ হয় একটি দেশে, সেই বীজের চাষ হয় অন্য কোনো দেশে, উৎপাদিত ফসলের প্যাকেজিং এবং প্রক্রিয়াজাত হয় তৃতীয় কোনো দেশে, তারপর সেগুলোর বিপণন ও সরবরাহের মধ্যমে পৌঁছে যায় ভোক্তা বা গ্রাহকের কাছে বিশ্বের অন্য কোনো প্রান্তে। তীব্র তাপপ্রবাহ বা বৈশ্বিক উষ্ণতা এ শৃঙ্খলের কোনো একটি পয়েন্টে ঐক্য নাশ করলে তার প্রভাব পরিলক্ষিত হবে বিশ্বব্যাপী। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে খাদ্যের স্বাভাবিক প্রাপ্যতা ব্যাহত হয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে এবং তার প্রভাব পড়েছে খাদ্যদ্রব্যের দামের ওপর। ফসলের ওপর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফল হতে পারে এ যুদ্ধের চেয়েও অনেক ভয়াবহ। এককথায়, বৈশ্বিক উষ্ণতা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য এক চরম হুমকি। অর্থনীতির বিভিন্ন খাত ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার অর্থই হচ্ছে বিমা খরচ বেড়ে যাওয়া। যেমন খরা, বন্যা বা তাপপ্রবাহে ফসলের ক্ষতি, কলকারখানায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি, পণ্য পরিবহনে দুর্ঘটনার সম্ভাব্যতা, এমনকি তাপপ্রবাহের কারণে জীবননাশের মতো ঘটনা, যেমন হিটস্ট্রোক আগের তুলনায় বেড়ে যাচ্ছে। এসবের প্রভাব পড়বে বিমা কোম্পানির ওপর। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে ঘনঘন দাবানলের কারণে সাধিত ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অপারগ হয়ে অনেক বিমা কোম্পানি ওই এলাকায় তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে। যারা এখনো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, ঝুঁকি পরিমাপের নতুন মডেল উদ্ভাবন করতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে, বিমা গ্রাহকের ঝুঁকি কমানোর সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতার কারণে, যা অর্থনীতির জন্য অকল্যাণকর।

বায়ুমণ্ডলর তাপমাত্রা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা। শিল্পোন্নত দেশগুলোই বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের জন্য অনেকাংশে দায়ী। তাই জলবায়ু পরিবর্তন রোধে তাদেরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। এ লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিতে দিন যতই গড়াবে, বায়ুমণ্ডলের ক্ষতি ততই বাড়তে থাকবে, পৃথিবী নামক গ্রহটা হয়ে উঠতে পারে বসবাসের অনুপযোগী। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের শহরের ভবনগুলোয় কংক্রিটের পরিমাণ কমাতে হবে। ভবনের ছাদে বাগান ও সবজি চাষ করতে হবে। এগুলো তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে। ঢাকার বেশ কিছু ভবনের ছাদে এক ধরনের রং ব্যবহার করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা ও নি¤œমানের বসতির ভেতরের তাপমাত্রা আট ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমেছে। যানবাহনে সবুজ ছাদের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য গবেষকেরা পরামর্শ দিচ্ছেন।

          অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক