Print Date & Time : 20 August 2025 Wednesday 11:12 pm

উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে দিশাহারা মানুষ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কার?

মো. মাঈন উদ্দীন: উচ্চহারে মূল্যস্ফীতিতে মানুষ দিশাহারা হয়ে পড়েছে। চাল, ডাল, মাছ, আলু, সবজি, ডিমসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যেভাবে লাগামহীন হারে বাড়ছে তাতে নি¤œবিত্ত, মধ্যবিত্তসহ সব শ্রেণির ক্রেতাদের মাঝে নানা ক্ষোভ অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। সিন্ডেকেটের থাবা থেকে কেউ রেহাই পাচ্ছে না।  বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত তথ্য থেকে দেখা যায় আগস্ট ২০২৩ মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল, যা জুন ও জুলাইয়ে ছিল যথাক্রমে ৯.৭৪ ও ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আগস্টের সার্বিক মূল্যস্ফীতির মধ্যে রেকর্ড বৃদ্ধি পেয়েছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। এ হার ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ, যা গত সাড়ে এগারো বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অথচ সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা। বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যেমন আলু, তেল, পেঁয়াজ, ডিম ইত্যাদির দাম বাড়িয়ে চলেছে। সরকার কিছু কিছু পণ্যের দাম নির্ধারণ করে ঘোষণা করলেও বাজারে তার প্রতিফলন নেই। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলেছে, পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ ও অসাধুদের অতি মুনাফা রোধে সরকার এ একাধিক বার একাধিক পণ্যের দাম নির্ধারণ করেছে। কিন্তু সেই দাম কার্যকর করা যায়নি। ক্রেতাদের বাড়তি দরেই পণ্য কিনতে হচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা অনেক সুবিধা গ্রহণ করলেও এবার আর তাদের ছাড় দেয়া হবে না। আলু পেঁয়াজ, ডিমসহ একেক সময় একেক পণ্যের দাম বাড়িয়ে তারা ভোক্তাদের পকেট কেটেছে। তাই ভোক্তার স্বার্থে অসাধুদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিছুদিন আগেও নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষি পণ্যের উৎপাদন, চাহিদা ও  মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে পণ্যের দাম নির্ধারণের কথা বললেও বাজারে তার প্রতিফলন নেই। পত্রিকার খবর ও সরেজমিনে ক্রেতাদের বক্তব্য অনুযায়ী দেখা যায়, প্রতি কেজি পেঁয়াজ পাইকারি আড়তে বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা ও খুচরা বাজারে ৮০-৯০ টাকা। প্রতি পিচ ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩-১৪ টাকা সরকার পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দায়িত্ব শেষ মনে করে বসে থাকে, অথচ ভোক্তারা অসহায়ের মতো বাড়তি টাকা ব্যয় করতে করতে শেষ হয়ে যাচ্ছে। বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এক বক্তব্যে বলেন, পণ্যের দাম কার্যকর করণে সারাদেশে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ঘোষিত মূল্য কার্যকর করতে কাজ চলমান আছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সংক্রান্ত সিন্ডিকেট নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বলছেন। কিন্তু এসব সিন্ডিকেট, অসাধু ব্যবসায়ীদের থেকে ভোক্তাদের কে রক্ষা করবে? কে কার কাছে জবাবদিহি করবে? নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষসহ সাধারণ ভোক্তারা আজ সিন্ডিকেটের থাবায় বন্দি। মাছ মাংসের কাছে ঘেষতে পারছে না অনেকে। আলু ভর্তা, ডিম, ডাল জোগাড় করাও কঠিন হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি সাধারণ সবজি তরকারিসহ আদা-রসুনের দামও মারাত্মক চড়া। অথচ আমাদের কৃষকেরা সঠিক মূল্য পায় না। তাদের কৃষি কাজের পেছনে যে উৎপাদন খরচ হয় তাও তারা মেটাতে কষ্ট হয়। মধ্যস্বত্বভোগী ও সিন্ডিকেট অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে মানুষ দিশাহারা। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে কৃষকের ১০ টাকা ৫০ পয়সাা খরচ হচ্ছে। কৃষক তো সর্বোচ্চ ১৫ টাকায় বিক্রি করে দিচ্ছে যা খুচরা বাজারে ৩২ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয় অথচ বাজারে আলুর দাম কেজি প্রতি ৪৫-৫০ টাকা। এদিকে দাম বৃদ্ধির পেছনে কারা দায়ী তা সরকারি সংস্থাও জানে। তারপরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। কয়েক মাস ধরে বাড়তি দরে ডিম বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বাজারে প্রতি ডজন ফার্মের ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫৫-১৬০ টাকা, যা গত বছরে একই সময় ডজন প্রতি ডিম বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকা। প্রতি কেজি মসুরডাল বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা যা আগে ১১৫ টাকা ছিল। আর ছোট দানা মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকা। বাজারে ব্রয়লার মুরগি কেজি প্রতি ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কক মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩২০ টাকা। এভাবে লাগামহীনভাবে যখন নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে তখন মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতি হারের অনেক নিচে। মূল্যস্ফীতির হার যখন ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ তখন মজুরি বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এভাবে সমাজে শ্রেণি-বিন্যাস-বৈষম্য দেখা দেয়। সমাজে মধ্যবিত্তরা নি¤œ মধ্যবিত্তে, নি¤œমধ্যবিত্তরা দরিদ্র এবং দরিদ্ররা অতিদরিদ্রের কাতারে নেমে আসছে। দেশে দরিদ্রের হার বেড়ে যাচ্ছে। দেশের মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বহার হ্রাসে সরকারকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। নিত্যপণ্যের দাম নির্ধারণে সরকারও কী অসহায় ? অথচ বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থাও স্বাভাবিক। তারপরও পণ্যের দাম বাড়ছে পাগলা ঘোড়ার গতিতে। ভোক্তার জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। চলমান অর্থনৈতিক মন্দা মানুষের আয় কমে যাচ্ছে। মানুষ ঋণগ্রস্ত হচ্ছে। পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আগে থেকেই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। অনিয়ম করলে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ভোক্তার সুরক্ষা দিতে সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। নিত্যপণ্যের দাম ভোক্তার সাধ্যের মধ্যে আনা অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কার? কে কার কাছে জবাবদিহি করবে? সরকার মূল্যস্ফীতির ঘোষণা দিয়েও বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। এ ব্যর্থতার দায় কি বাংলাদেশ ব্যাংকের, না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। আমরা জানি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে থাকা মূল অস্ত্র হচ্ছে মুদ্রানীতির কার্যকর ব্যবহার। অর্থাৎ সুদ হার বাড়িয়ে বা কমিয়ে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এ কাজ করে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি বিভাগ। মুদ্রানীতি তৈরি করা, সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম দায়িত্ব। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, ভারত, থাইল্যান্ড, কানাডাসহ বহু দেশে মুদ্রানীতির কমিটির সদস্যদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, গবেষকরা থাকেন। অথচ বাংলাদেশের যে মুদ্রানীতি কমিটি আছে তার সব সদস্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। অথচ অর্থনীতিবিদ বিশেষজ্ঞ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ সরকারের অনেক অভিজ্ঞ কর্মকর্তাও থাকতে পারত। এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়  যে, মুদ্রানীতি নিয়ে বিভিন্ন মতামত শোনা, জবাবদিহির চর্চা আমাদের দেশে এখনও গড়ে ওঠেনি। সাধারণ মানুষকে যে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তা খালি চোখে দেখেও কারও কোনো দায়িত্ব বা জবাবদিহিতা নেই। যতদূর জানা যায়, বিশ্ব অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির অধ্যায় শুরু হয় ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে। আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর ন্যস্ত হয় তখন থেকেই। ইনফ্রেশন টার্গেটিং বিষয়টিও তখন থেকেই শুরু হয়। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির হার নির্ধারণ করেই মুদ্রানীতি তৈরি করা শুরু হয়। এ কাজটি প্রথম করেছিল নিউজিল্যান্ড। ১৯৯৭ সালে মন্দার পর থেকে তারা এ নীতি অনুসরণ করে আসছে। বেশির ভাগ দেশেরই লক্ষ্য থাকে মূল্যস্ফীতি ২ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে রাখা। আমাদের দেশের সরকারও বাজেটের সময় এলে মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়ে থাকে। যদিও পরবর্তী সময়ে তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে উদাসীনতার লক্ষ্য করা যায়। বিশ্বের অনেক দেশেই মূল্যস্ফীতির হার নি¤œমুখী হলেও আমাদের দেশের ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু কেন হচ্ছে এসব! যুক্তরাজ্যে চলতি বছরের জুলাই বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার কমে ১৫ মাসের মধ্যে সর্বনি¤œ হয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার জুনে ৭ দশমিক ৯ থেকে কমে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। কানাডায় পরিসংখ্যান বিভাগের হিসাব থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের জুনে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৮ দশমিক ১ শতাংশ দারায়। এ বছরে মে মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২৩ সালে জুলাইয়ে এ হার দাঁড়ায় ৩ দশমিক ২৭ শতাংশ। এভাবে দেখা যায়, বিশ্বের অধিকাংশ দেশে মূল্যস্ফীতির হার নি¤œমুখী। অথচ আমাদের দেশে উচ্চ হারে মূল্যস্ফীতিতে মানুষ দিশাহারা। সরকার চোখের সামনে তা দেখতে পেয়েও যেন অসহায়ের মতো শুধু নানা বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো সিন্ডিকেট বা অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজির হাত থেকে ভোক্তাদের মুক্তির কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না। সব কিছুর মূলে রয়েছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, আইনের কঠোর প্রয়োগের ঘাটতি। অর্থনীতিকে সাবলীলভাবে চালাতে হলে দুর্নীতি দূর করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। দেশের সম্পদ সুরক্ষায়, অপচয় রোধ ও দেশপ্রেমে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মুনাফাখোরি একশ্রেণির ব্যবসায়ীর মূলোৎপাটন করে মজুদদারি ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। কৃষকের ন্যায্য পণ্যমূল্য পেতে মধ্যস্বত্বভোগীদের স্তর ভাঙতে হবে। অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে, জনগণকে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে মূল্যস্ফীতি উচ্চহার হ্রাসে সরকারকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। 

ব্যাংকার, মুক্ত লেখক