মো. মাঈন উদ্দীন: মানুষের জীবন একটি ঘটনা। জীবনের নানা ঘটনার মধ্যে রয়েছে অর্জনের আনন্দ, হারানোর বেদনা, সুখ ও দুঃখ নিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে প্রতিটি মুহূর্ত। এভাবে আমাদের জীবন থেকে চলে গেল একটি বছর। পৃথিবীর বয়স বেড়ে গেল আরও এক বছর। কিন্তু আমরা যদি বিদায় বছরের পেছনে তাকাই তাহলে দেখতে পাব নানা ঘটনা, ঘটনার পেছনে ঘটনা, দুঃখ, সুখ ও হাসি-কান্নার নানা চিত্র। এসব কিছুর মাঝে যে বিষয়টি জড়িত তা হন অর্থ। অর্থের ব্যবস্থাপনা সম্পদের বণ্টন, অর্থের সঠিক ব্যবস্থাপনার ওপর মানুষের জীবনবোধ, জীবনের গতি চিত্রিত হয়। বিগত দুটি বছর ২০২১, ২০২২ গোটা বিশ্ব কোভিড-১৯ কেন্দ্রিক করোনা মহামারি ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে প্রভাবিত অর্থনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাত প্রত্যক্ষ করেছে। ২০২৩ সালে ও জীবনসম্পৃক্ত বেশ কিছু পরিস্থিতি আমরা অতিক্রম করেছি। ২০২৩ সালে সবচেয়ে আলোচিত ছিল দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির-ডলার সংকট, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ও তারল্যর সংকটের নানা খবর।
নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের কিছু অগ্রগতি রয়েছে। ২০২৩ সালে ও বড় কয়েকটি প্রকল্পের কাজ শেষে হয়েছে। মেট্রোরেল চালু হয়েছে, চালু হয়েছে এক্সপ্রেসওয়ে, চট্টগ্রাম চালু হয়েছে বঙ্গবন্ধু টানেল এবং ঢাকা-কক্সবাজার সরাসরি ট্রেন। তবে শিল্প খাতে কোনো অগ্রগতি লক্ষণীয় নেই। বিশেষ করে ইস্পাত, সিমেন্ট, রড, কারখানা, কোনো সুখবর নেই। প্রকল্পগুলোর কাজে অনেক ধীর গতি লক্ষণীয়।
সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বাড়ছে না। দেশে টিআইএন-ধারী করদাতা আছে ৯৩ লাখের মতো। অথছ ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র ২৩ লাখ ৫০ হাজার ব্যক্তি ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিয়েছে। যার মাধ্যমে আদায় হয়েছে ৪৩০৫ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের রাজস্ব আশানুরূপ না বাড়ায় সরকারের উন্নয়ন ব্যয়ে ভীষণ টান পড়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে খরচ হয়েছে মাত্র ৪৬ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা, যা বিগত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
দ্রব্যমূল্য: মূল্যস্ফীতি নিরিখে বলা যায় ২০২৩ সাল খুব একটা ভালো যায়নি। বছরের শুরুতে নিত্যপণ্যে দাম যেমন ছিল তা দফায় দফায় বৃদ্ধি পেয়ে শেষেও তা ঊর্ধ্বমুখীই থেকেই যায়। সব শাকসবজি, আলু, পেঁয়াজ, টমেটো, পেঁপে, কপি, কাঁচা মরিচ, করলা, লাউ, বেগুনসহ নিত্যপণ্যে দাম এত বেড়েছে তাতে ভোক্তা সাধারণ অসহনীয় কষ্টে দিনাতিপাত করছে। ২০২৩ সাল ছিল হতাশার বছর। ঋণের বছর, বড় কষ্টের বছর। অন্তত নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুয়ের জন্য পুরো বছরটি ভালো যায়নি। জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণে এ বছর মূল্যস্ফীতি রেকর্ড গড়েছে। গত আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রথম বারের মতো দুই অঙ্কের ঘর স্পর্শ করে, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। পরের তিন মাস মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ শতাংশের ওপরে। এর মধ্যে অক্টোবরে ছিল ১২.৫৬ শতাংশ, যা ছিল গত ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাজার নিয়ন্ত্রণের জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা দফায় দফায় তদারকি করলেও খুব বেশি সুফল আসেনি। ব্যবসায়ীরা নিজেরা ইচ্ছা মতো দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। টিসিবি দৈনন্দিন পণ্যের দামের তালিকা দেখলে বোঝা যায় ৫২টি পণ্যের মধ্যে ৩৫টি পণ্যের দাম বেড়েছে। বাজারে একের পর এক নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় স্বল্প আয়ের মানুষ কষ্টে দিনাতিপাত করছে।
ব্যাংক খাত: বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল ব্যাংক খাত। খেলাপি ঋণ, সুদহার ও বিনিময় হার নিয়ে বছরজুড়ে আলোচনা ছিল। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতি বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ হিসাবও বলছে, জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা দাঁড়িয়ে গেছে। এপ্রিল-জুন/২০২৩ সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। জানুয়ারি-জুন/২০২৩ ছয় মাসে বেড়েছে ৩৫ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞদের মতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশিÑসাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। খেলাপি গ্রাহকদের কে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। বিশেষজ্ঞরা ঋণখেলাপি ট্রাইবুনাল গঠনের কথা বলেছেন। ট্রাইবুনালে প্রত্যেক ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপিদের বিচার করতে হবে। উন্নত দেশগুলোর মতো খেলাপি গ্রাহকদের মাল ক্রোক করাসহ তাদের জেলে পাঠাতে হবে। বিচারে কোনো আপিলের সুযোগ রাখা যাবে না। অর্থঋণ আদালতের কাজ দ্রুত ও যুগোপযোগী করতে হবে। খেলাপি ঋণ বাড়ার অন্যতম কারণ হলো ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেয়া।
আবার ১৪টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি হয় ৩৭ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা। খেলাপিসহ ব্যাংক খাতের চাপে থাকা সম্পদ রয়েছে ২৫ শতাংশের বেশি। বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক ও শরিয়াহভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংক থেকে বেনামি ঋণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বছরজুড়ে। সুশাসন ও আর্থিক পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটায় সম্প্রতি ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আরও কয়েকটি ব্যাংক ধারদেনা করে চলছে। গত জুলাই ২০২৩ থেকে ১৮২ দিন ট্রেজারি বিলের ৬ মাসের গড় সুদের সঙ্গে একটি মার্জিন যোগ করে সুদহার নির্ধারণ করা হচ্ছে। এ ব্যবস্থায় ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণে সুদহার ছিল ১১.৪৭ শতাংশ। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে গত জুন ২০২৩ পর্যন্ত সুদের সর্বোচ্চ হার ছিল ৯ শতাংশ।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে কলমানিতে সুদের হার ছিল ৯.১৪ শতাংশ, যা গত ১১ (এগার) বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১২ সালের পর এবারই কলমানিতে সর্বোচ্চ সুদ হয়। ওই বছর ১২ দশমিক ৮২ শতাংশ উঠেছিল সুদহার।
ডলার সংকট: বছরজুড়ে আলোচনা ছিল ডলারের দর নিয়ে। বর্তমানে রেমিট্যান্সে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ থাকলেও ব্যাংকগুলো ডলার কিনছে ১২০-১২২ টাকায়। ডলারের রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে চলছে অনেকদিন ধরে। ডলারের দাম ২০২৩ সালে টাকার বিপরীতে অনেক বেড়েছিল। টাকার অবমূল্যায়ন ঘটেছে ২৫-৩০ শতাংশ। এ প্রেক্ষাপটে আইএমএফ থেকে ঋণ নিতে হয়েছে ৪.৭০ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালে আমরা ২ কিস্তি ঋণের ডলার পেয়েছি।
আমদানি, রপ্তানি ও রেমিটেন্স: ডলার সংকটের কারণে একদিকে যেমন রিজার্ভ কমতে শুরু করে পাশাপাশি কড়াকড়ির কারণে কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ার প্রভাব পড়ে রপ্তানি খাতে। আমাদের যে পরিমাণ রপ্তানি হয় সে অনুযায়ী ডলার দেশে না এসে পাচার হয়ে যাওয়া। সে বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে আমাদের রাজস্ব আদায়ে, যে নিম্নহার, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো খাতে বিনিয়োগ করতে না পারা, বৈদেশিক খাতের আয় বিনিয়োগের ভঙ্গুর অবস্থা, রিজার্ভের খারাপ অবস্থাসহ সব সূচকেই তা নেতিবাচক হয়ে পড়ছে। তথ্য উপাত্তের ঘাটতির পাশাপাশি বাজারের ওপরে সরকারের নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ২০২২ সাল থেকে দেশে প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি কমেছে। ২০২২ সালে যেখানে মাসে প্রায় ২০০ কোটি ডলার প্রবাসী আয় আসত, সেখানে ২০২৩ সালে প্রথম তিন প্রান্তিকে প্রতি মাসে গড়ে ১৫০-১৬০ কোটি ডলার এসেছে। বাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়ে রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বৈদেশিক অনুদান থেকে। এই চার খাতেই আয়ের ধারা নিম্নমুখী।
বৈশ্বিক মন্দায় রপ্তানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানি জুলাই-আগস্ট (২০২৩) কমেছে ২৮ শতাংশ ও এলসি খোলা কমেছে ১৭ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় বেড়েছিল ৩৪.৩৮ শতাংশ। গত অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ৬.৬৭ শতাংশ। ১ বছরের ব্যবধানে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় ২৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টের তুলনায় চলতি অর্ধবছরের এ সময়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ। রেমিট্যান্সের দিকে দেখলে তা দেখা যায়, এ বছর জুনে রেমিট্যান্স এসেছে ২২০ কোটি ডলার, জুলাইয়ে তা কমে ১৬৭ কোটি ডালার, আগস্টে তা আরও কমে ১৬০ কোটি ডলার এসেছে। ৩ মাসের হিসাবে রেমিট্যান্স এসেছে ৫৭৭ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমেছিল ১৫.১২ শতাংশ। গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে এসেছিল ১২.২৭ শতাংশ। চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের একই সময়ে বাড়ার পরিবর্তে প্রবৃদ্ধি কমেছে ১৩.৫৬ শতাংশ। বৈদেশিক অনুদানের গতিও নিম্নমুখী ছিল।
সর্বোপরি বলা যায়, ২০২৩ সাল ছিল অর্থনৈতিকভাবে ভীষণ অনিশ্চয়তার বছর অস্থিতিশীলতা ছিল দিন সর্বত্র। অর্থনীতির মূল কাঠামো থেকে বিচ্চুতি দেখা গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতিও বেড়ে চলেছে। নতুন বছরে সরকার নতুন করে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বদলের জন্য সঠিক নীতি না নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য মনিটরিং ব্যবস্থা জোরধার করতে হবে। সিকিউরিটি এক্সচেঞ্চ কমিশন, শ্রম মন্ত্রণালয়, বেপজা, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়স বেশ কিছু বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২-এর চূড়ান্ত ফলাফল অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যের হার কম হলেও বেড়েছে আয়বৈষম্য। আয় ও সম্পদের বণ্টন অসম হওয়ায় বৈষম্য বেড়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া কম দায়ী নয়। তাই ২০২৪ সাল হোক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, আয় ও সম্পদ বণ্টনে সুষম ব্যবস্থা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বছর।
ব্যাংকার
main706@gmail.com