এসএম রুবেল, কক্সবাজার: প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সোনাদিয়া দ্বীপের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার নির্দেশ দেয়ার এক মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। অথচ এরই মধ্যে গত সপ্তাহে গড়ে উঠেছে আরও দুটি অবৈধ কটেজ। এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে জীববৈচিত্র্য যেমন হুমকিতে পড়ছে, তেমনি মাদক বেচাকেনাসহ মানবপাচারের নিরাপদ আস্তানায় পরিণত হচ্ছে এ দ্বীপ।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, শিগগির এসব অবৈধ স্থাপনা অপসারণের ব্যবস্থা না নিলে চলতি মাসে আরও কয়েকটি অবৈধ কটেজ নির্মাণের উদ্যোগ নেবে কয়েকটি চক্র।
জানা গেছে, কক্সবাজার শহরের উত্তর-পশ্চিমে এবং মহেশখালী উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত জীববৈচিত্র্যের অনন্য নিদর্শন সোনাদিয়া দ্বীপ। দ্বীপটি বঙ্গোপসাগরের তীরঘেঁষে গড়ে উঠেছে। ৯ বর্গকিলোমিটারের এ দ্বীপে নারিকেল, ঝাউ, নিসিন্দা ও কেয়া গাছ রয়েছে। এছাড়া রয়েছে চিংড়ি, লবস্টার, শামুক, ঝিনুক, ডলফিন, লাল কাঁকড়া ও কচ্ছপের আবাস। অপরদিকে শীতকালে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে পরিযায়ী পাখি ও কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসে এ দ্বীপে।
সরজমিনে দেখা গেছে, সোনাদিয়ায় অবৈধভাবে পাঁচটি কটেজ নির্মাণ করা হয়েছে। এসব কটেজ মালিকরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লোভনীয় অফার দিয়ে মানুষদের দ্বীপে আসার আহ্বান করছেন। আর সেখানে এসে নারী-পুরুষ অবাধে মেলামেশা ও অবৈধভাবে অনিরাপদ রাতযাপন করছেন। এরই মধ্যে দ্বীপে মাদক সেবন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অবাধে মেলামেশা ও রাতযাপন, দ্বীপে ঝাউগাছ কেটে আগুন জ্বালানো, উচ্চ স্বরে গানবাজনা করা, লাল কাঁকড়ার বিচরণ স্থানে ফুটবল ও ভলিবল খেলা, কচ্ছপের ডিম পাড়ার স্থানে তাঁবু স্থাপনসহ মাদক বেচাকেনা প্রভৃতি বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) এক পত্রসূত্রে জানা গেছে, গত ২৬ জানুয়ারি সোনাদিয়া ইকো-ট্যুরিজম পার্কের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা অবৈধ কটেজ অপসারণসহ দ্বীপে পর্যটকদের অবৈধভাবে রাতযাপন নিষিদ্ধ করার জন্য কক্সবাজারের ডিসিকে নির্দেশ দেয়া হয়। বেজার ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) উপসচিব মোহাম্মদ নাজমুল হাসান স্বাক্ষরিত ওই পত্রে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, সোনাদিয়ায় অসাধু ব্যবসায়ীরা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে একাধিক স্থাপনা নির্মাণ করেছে। সেখানে আগত পর্যটকরা মাদক সেবনসহ অনৈতিক কাজে লিপ্ত হচ্ছে।
এছাড়া ১৯৯৯ সালে সোনাদিয়া প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হয়। এ আইনে দ্বীপে কিছু কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করা হয়। নিষিদ্ধ এসব কার্যকলাপের মধ্যে রয়েছেÑপ্রাকৃতিক বন ও গাছপালা কর্তন বা আহরণ; সব ধরনের শিকার ও বন্যপ্রাণী হত্যা; ঝিনুক, কোরাল, কচ্ছপ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণী ধরা বা সংগ্রহ; প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংসকারী সব ধরনের কার্যকলাপ; ভূমি ও পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট বা পরিবর্তন করতে পারে এমন কাজ; মাটি, পানি, বায়ু এবং শব্দদূষণকারী শিল্প বা প্রতিষ্ঠান স্থাপন; মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর ক্ষতিকারক যে কোনো প্রকার কার্যাবলি; নদী-জলাশয়-লেক-জলাভূমিতে বসতবাড়ি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পয়ঃপ্রণালিসৃষ্ট বর্জ্য ও তরল বর্জ্য নির্গমন এবং কঠিন বর্জন অপসারণ; যান্ত্রিক বা ম্যানুয়াল বা অন্য কোনো পদ্ধতিতে পাথরসহ অন্য যেকোনো খনিজ সম্পদ আহরণ। তাই পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদের নির্দেশ দেয় বেজা।
তবে নির্দেশনার এক মাস পেরিয়ে গেলেও মহেশখালী উপজেলা প্রশাসন কিংবা কক্সবাজার জেলা প্রশাসন থেকে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
এ বিষয়ে কক্সবাজারের ডিসি মুহাম্মদ শাহীন ইমরান জানান, সোনাদিয়ার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও রাতযাপন নিষিদ্ধের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পত্র হাতে পেয়েছেন। তবে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর আগে প্রস্তুতি দরকার। শিগগিরই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে।
অপরদিকে পরিবেশ সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক পাখি সংরক্ষক সংস্থা বার্ড লাইফ ইন্টারন্যাশনাল এ দ্বীপকে পাখির বিচরণক্ষেত্র হিসেবে ঘোষণা করে। তারা আরও জানিয়েছে, বিপন্ন প্রজাতি চামচঠোঁট পাখির বিচরণ শুধু বাংলাদেশের সোনাদিয়ায়ই দেখা মিলেছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের এ দুঃসময়ে পরিবেশের ভারসাম্য ধরে রাখতে দ্বীপের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।