উত্তরের বন্যা : কৃষকের ক্ষতি ৭০০ কোটি টাকা ছাড়াবে

পলাশ শরিফ, উত্তরাঞ্চল থেকে ফিরে: বন্যায় উত্তরের আট জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ ৩৬ হাজার পরিবার বা প্রায় ২৫ লাখ মানুষ। তারা বসত ঘরবাড়ি, আবাদি জমি, জমির ফসল, গবাদিপশু, পুকুরের মাছ ও গাছপালা হারিয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এর মধ্যে বসত জমি, ঘরবাড়ি ও জমির ফসল হারানো মানুষের সংখ্যাই বেশি। সরকারিভাবে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে বন্যায় আক্রান্ত প্রতিটি পরিবার সর্বনিম্ন এক লাখ থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতির মুখে পড়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, বন্যায় উত্তর জনপদে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষকরা। প্রায় ২০ লাখ কৃষকের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। একইভাবে মাছচাষি-খামারিদের প্রায় ৩০০ কোটি টাকার মাছ বানের পানিতে ভেসে গেছে। এছাড়া রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে। একইভাবে খানাখন্দ আর ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজ-কালভার্টের কারণে যানবাহনেও গতি নেই।

কৃষকের ক্ষতি ৭০০ কোটি ছাড়িয়েছে ‘এমন অবস্থাত আগে পড়ি নাই। বানের পানিত চাইর একর জমির ধান পচি নষ্ট হইছে। এখনও জমিতে পানি বান্দি আছে। ধানের পেছনোত প্রায় ৪০ হাজার টাকা খরচ হইছে। নষ্ট না হইলে প্রায় দেড় থাকি পৌনে দু’লাখ টাকার ধান হইতো। খরচ বাদ দিয়া কম করি হইলেও এক লাখ টাকা থাইকতো। এখন কিচ্ছু নাই, হঠাৎ বানোত সউগ শ্যাষ। নতুন করি ধান লাগানোর অবস্থাও নাই। জমিত পানি, ধানের চারারও সংকট।’কথাগুলো বলছিলেন কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সচ্ছল কৃষক আবদুর রহিম। তিনি উলিপুর উপজেলার বজরা ইউনিয়নের কালপানি বজরা গ্রামের বাসিন্দা। বন্যায় বসত ঘরবাড়ি রক্ষা পেলেও ফসল হারিয়ে সচ্ছল এ কৃষকের চোখে-মুখেও এখন হতাশার ছাপ।

আবদুর রহিম একা নন। জেলা প্রশাসনের হিসেবে, উত্তরের বন্যাকবলিত জেলা কুড়িগ্রামে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ ৪৩ হাজার। দ্বিতীয় দফার বন্যায় এ জেলায় প্রায় এক লাখ তিন হাজার হেক্টর ফসলি জমির প্রায় অর্ধেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে কুড়িগ্রামের ৫০ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে।

আর রংপুর বিভাগের আট জেলায় ক্ষতির মুখে পড়েছে প্রায় তিন লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর জমি। সব মিলিয়ে উত্তরের আট জেলায় আমনসহ অন্য ফসলে চাষিদের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৭০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, রংপুর বিভাগের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও গাইবান্ধা জেলায় প্রায় ৯ লাখ ৮৯ হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশই প্লাবিত হয়েছে। সে হিসেবে প্রায় তিন লাখ ৩৩ হাজার ১৫ হেক্টর জমির ধান বন্যায় তলিয়ে গেছে। সরকারিভাবে ওই অঞ্চলের কৃষির ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা হয়নি। তারপরও বন্যার কারণে রংপুর বিভাগে কৃষকের ক্ষতির অঙ্ক প্রায় ৭০০ কোটি টাকায় দাঁড়াতে পারে বলে জানিয়েছেন কৃষি বিভাগের দায়িত্বশীলরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর রংপুর আঞ্চলিক অফিসের অতিরিক্ত পরিচালক শাহ আলম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বন্যায় রংপুর বিভাগে রোপা আমনসহ শাকসবজির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জলাবদ্ধতার কারণে এখনই প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করা যাচ্ছে না। বন্যার পানি সরে গেলে প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাবে। পাশাপাশি ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিকল্প ফসল উৎপাদনের বিষয়ে কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।’

এদিকে উত্তরের আট জেলায় ছোট-বড় মাছচাষি ও খামারিদের ক্ষতি ৩০০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। রংপুর বিভাগের আট জেলায় প্রায় ৯০ হাজার মাছের পুকুর ও খামার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এ ক্ষতি হয়েছে।

বিপর্যস্ত রেলপথ, সড়কে খানাখন্দ-ধীরগতি বন্যায় বাংলাদেশ রেলওয়ের লালমনিরহাট বিভাগে প্রায় ১০০ কিলোমিটার রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই অঞ্চলের আট জেলায় ১৭৬টি পয়েন্টে রেলপথ-ব্রিজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে কারণে প্রায় ১০ দিন ধরে উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পার্বতীপুর-দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় রুটের রেলপথ। এ কারণে পাবর্তীপুর থেকে দিনাজপুর, দিনাজপুর থেকে ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড়, কাউনিয়া থেকে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট থেকে বুড়িমারী রুটে চলচালকারী আন্তঃনগর একতা ও দ্রুতযানসহ ১১ জোড়া ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগে প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত রেল কর্তৃপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত ৯৬টি পয়েন্ট মেরামত করেছে। বাকি পয়েন্টগুলো মেরামতের পর রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক করতে আরও এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।

লালমনিরহাট রেলওয়ের বিভাগীয় ম্যানেজার (ডিআরএম) নাজমুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বন্যায় রেলওয়ের ক্ষতিগ্রস্ত পয়েন্টগুলোর অধিকাংশই এরই মধ্যে মেরামত করা হয়েছে। বাকি ক্ষতিগ্রস্ত পয়েন্টগুলো মেরামতের জন্য কাজ চলছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরো সময় লাগবে। ঈদের আগে যোগাযোগ চালুর বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করছি।’

এদিকে বন্যায় রাস্তাঘাটেরও উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। রংপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের ২৪৩টি কালভার্টের মধ্যে ১৪৩টি কালভার্ট ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। প্লাবিত হওয়ার পর ব্রিজ-কালভার্ট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠা, রাস্তায় খানাখন্দ ও কাদার কারণে রংপুর বিভাগের কাঁচা-পাকা প্রায় ৩৪০ কিলোমিটার সড়কে যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এর মধ্যে দিনাজপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও রংপুর জেলায় রাস্তাঘাটের বেশি ক্ষতি হয়েছে। অবশ্য এ অঞ্চলে বন্যায় রাস্তার ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ এখনও জানা যায়নি। তবে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট মেরামতে প্রায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। রাস্তা সংস্কারের জন্য এ অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের রংপুর বিভাগীয় প্রকৌশলী ফিরোজ আক্তার শেয়ার বিজকে বলেন, ‘রংপুর বিভাগের ৩৪০ কিলোমিটার সড়ক সচল রাখতে সড়ক বিভাগের প্রকৌশলীরা দিন-রাত কাজ করেছেন। তাই কয়েকদিনের মধ্যেই বন্ধ সড়কগুলোতে যান চলাচল শুরু হয়েছে। তবে খানাখন্দের কারণে ধীরগতিতে যান চলাচল করছে। সড়কগুলোর মধ্যমেয়াদি সংস্কারের জন্য ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এক কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে সংস্কারকাজ শুরু হয়েছে।’

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন শেয়ার বিজ-এর রংপুর প্রতিনিধি হুমায়ুন কবির মানিক, লালমনিরহাট প্রতিনিধি জাহেদুল ইসলাম সমাপ্ত ও কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আমানুর রহমান খোকন।]