উধাও তিন খেলাপি উদ্যোক্তা: ৯ ব্যাংকে সিলভিয়া গ্রুপের ৯০০ কোটি টাকা ঋণ

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকার বাসিন্দা হুমায়ুন কবির, মিজানুর রহমান শাহীন ও মজিবুর রহমান মিলন। এ তিন ভাই মিলে প্রতিষ্ঠা করেন একের পর এক প্রতিষ্ঠান। আর তাদের উদারভাবে ঋণ দেয় বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক। আট প্রতিষ্ঠানের নামে ৯টি ব্যাংক থেকে ৯০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তিন ভাই দীর্ঘদিন ধরে উধাও। ব্যাংকগুলো তাদের ঋণ দিয়ে আছে বিপাকে।

ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামভিত্তিক সিলভিয়া গ্রুপকে দেওয়া ঋণের মধ্যে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ২৯৯ কোটি, ব্যাংক এশিয়ার ১৪০ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের ১২৪ কোটি, ঢাকা ব্যাংকের ১৪৫ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৮৯ কোটি, ইস্টার্ন ব্যাংকের ৪৮ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ৪৩ কোটি, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের সাত কোটি ২০ লাখ ও যমুনা ব্যাংকে পাঁচ কোটি ১১ লাখ টাকা। তাদের নেওয়া সব ঋণই এখন খেলাপি। ব্যাংকের টাকা মেরে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তারা দেশ ছেড়েছেন। একজন আছেন কানাডায়, অন্যজন সিঙ্গাপুরে। আরেক জনের অবস্থান জানা যায়নি। অনিয়ম আড়াল করতে তড়িঘড়ি করে কিছু ঋণ এরই মধ্যে অবলোপনও করেছে ব্যাংকগুলো।

গত সোমবার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক ৭৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ঢাকা ব্যাংক মুরাদপুর শাখার দায়ের করা মামলায় মুহাম্মদ মিজানুর রহমান শাহীনকে এক বছরের কারাদণ্ড দেন। পাশাপাশি অর্থদণ্ডও দেন। ফলে আবারও আলোচনায় এলো সিলভিয়া গ্রুপের ঋণখেলাপির বিষয়টি।

আদালত থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মেসার্স আহমেদ মুজতবা রি-রোলিং মিলস ও ফয়জুন শিপব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মালিক হিসেবে ঢাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন শাহীন। এ বিনিয়োগ সমন্বয়ের জন্য ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর শাহীন ব্যাংকের বরাবর ৪৯ কোটি ৯৪ লাখ ৪৮ হাজার ২৬৫ টাকা ৪৭ পয়সার একটি চেক দেন। এরপর ২৮ নভেম্বর চেকটি ডিজ-অর্নার হয়। এ অবস্থায় বিভিন্ন আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর ২০১৪ সালের ৯ জানুয়ারি ব্যাংক কর্তৃপক্ষের তরফে মুরাদপুর শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার মুহাম্মদ অহিদুল আলম উল্লিখিত আবাসন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। মামলার রায়ে গত সোমবার আদালতের বিচারক ব্যবসায়ী শাহীনকে উল্লিখিত অঙ্কের টাকা জরিমানা ছাড়াও এক বছরের কারাদণ্ড দেন।

অন্যদিকে ফয়জুন অক্সিজেন প্লান্ট ও ফয়জুন শিপব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক হিসেবে মুহাম্মদ মিজানুর রহমান শাহীন ব্যাংকের একই শাখা থেকে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করেন। ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর শাহীন একইভাবে ব্যাংকের বরাবর ২৪ কোটি ৭১ লাখ ৭৮ হাজার ৫৮৭ টাকা ৯৪ পয়সার একটি চেক প্রদান করেন। কিন্তু পর্যাপ্ত তহবিলের অভাবে এর পরের দিনই চেকটি ডিজ-অর্নার হয়। এ ঘটনায় বিভিন্ন আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর একই বছর ৯ জানুয়ারি এ টাকা উদ্ধারে একটি মামলা করেন ব্যাংক কর্মকর্তা মুহাম্মদ অহিদুল আলম। গতকাল একই সময় এ মামলায় রায় ঘোষণা করেন বিচারক মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম। রায়ে উল্লিখিত চেকের টাকা জরিমানা ছাড়াও তাকে এক বছরের কারাভোগের আদেশ দেওয়া হয়েছে।

এ গ্রুপের ঘনিষ্ঠ এক সূত্র জানান, মজিবুর রহমান মিলন, মিজানুর রহমান শাহীন ও হুমায়ুন কবির তিন ভাই। মজিবুর ও মিজানুর এখন সপরিবারে দেশের বাইরে আছেন। এদের মধ্যে মজিবুর সিঙ্গাপুর ও মিজানুর কানাডায় আছেন বলে তারা শুনেছেন। অপর ভাই হুমায়ুন কবির দেশে যাতায়াতের মধ্যে আছেন।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, মিজানুর রহমান শাহীন এসব প্রতিষ্ঠান নিয়ে মিশম্যাক গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ গ্রুপের ১২টি প্রতিষ্ঠানকে তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই তালিকায় মিশম্যাপ শিপব্রেকিং, ফয়জুন শিপব্রেকিং ও বিআর স্টিল মিলের পাশাপাশি নাম রয়েছে মিশম্যাক ডেভেলপমেন্ট, মিশম্যাক ল্যান্ডস ডেভেলপমেন্ট, মিশকাত শিপব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রি, মিশুটিন শিপব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রি, ফয়জুন ট্রেডার্স, ফয়জুন অক্সিজেন প্ল্যান্ট, ফয়জুন এসিথিলিনে প্ল্যান্ট, মিশম্যাক এগ্রো ইন্ডাস্ট্রি ও আহমেদ মোস্তফা রি-রোলিং মিল। এখানেও বেশ কয়েকটি মোবাইল নম্বর ও ল্যান্ডফোন নম্বর রয়েছে। এসব নম্বরের বেশিরভাগই বন্ধ।

চট্টগ্রামের কয়েকটি ব্যাংকের শাখা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন ভাইয়ের প্রকৃত ঋণ আরও অনেক বেশি। এছাড়া মজিবুর রহমান মিলনের মালিকানা দেখিয়ে মুহিব স্টিল অ্যান্ড শিপ রি-সাইক্লিংয়ের নামে চারটি ব্যাংক থেকে ২০৭ কোটি টাকা নেওয়া হলেও এর প্রকৃত মালিক হুমায়ুন কবির নামে তার আরেক ভাই। বাংলাদেশ শিপ ব্রেকারস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য মুহিব স্টিলের মালিক হিসেবে হুমায়ুন কবিরের নাম রয়েছে। এছাড়া মজিবুর রহমান মিলনের মালিকানাধীন আহমেদ মোস্তফা স্টিল ও সিলভিয়া শিপব্রেকিং এ অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। আর মিজানুর রহমান শাহীনের মালিকানাধীন মিশম্যাপ শিপব্রেকিং ও ফয়জুন শিপব্রেকিংয়ের সদস্য।

এ গ্রুপকে ঋণ প্রদানকারী একটি ব্যাংক শাখার শীর্ষ এক কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অসুস্থতার কথা বলে মিজানুর রহমান শাহীন দীর্ঘদিন কানাডায় আছেন বলে তিনি শুনেছেন। আর মজিবুর রহমান দেশের বাইরে ও দেশে যাতায়াতের মধ্যে আছেন। বেশ কিছুদিন ধরে তারা আর ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না। অন্য একটি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক জানান, অনেক দিন ধরেই শিপব্রেকিংয়ের ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। এছাড়া মিশম্যাপ জাহাজ ভাঙা ব্যবসায় ঋণ নিয়ে সেই টাকা দিয়ে জমি কেনায় তাদের বড় অঙ্কের টাকা আটকে গেছে। ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে এখন দেশের বাইরে আছেন। গত দুই বছর ধরে কোনো যোগাযোগও নেই। ফলে ঋণের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে খুব বেশি অনিশ্চয়তায় আছেন। তবে তাদের বেশ কিছু সম্পদ থাকায় তারা চলে আসবেন বলে তার ধারণা।