উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র ও সুশাসন কতটা জরুরি

মো. জিল্লুর রহমান: টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো গণতন্ত্র ও সুশাসন। বর্তমানে দেশে গণতন্ত্র আছে কি না, অনেকেই সেই প্রশ্ন তুলেছেন। অনেকেই বলছেন, দেশে বর্তমানে কর্তৃত্ববাদী সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান। অনেকেই মনে করেন, সুশাসন না হলে উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য এবং গণতন্ত্র ছাড়া সুশাসন নিশ্চিত করা যাবে না। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উত্তরাধিকার ধারা বর্তমান। সত্যিকারের রাজনীতি করতে চাইলে দলগুলোকে গণতান্ত্রিক হতে হবে। দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য নিয়ে আলাপ-আলোচনার সুযোগ থাকতে হবে। ভিন্ন মতকে শ্রদ্ধা ও বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। দুঃখজনক হলো, এ চর্চা এদেশের রাজনীতিতে একদমই নেই। আছে শুধু হালুয়া-রুটির ভাগ-বাটোয়ারা।

গণতন্ত্র হলো সেই চর্চা যেখানে চিন্তার, কথা বলার, কাজের ও উপাসনার স্বাধীনতা থাকে। এটাই গণতন্ত্রের মূল দর্শন। গণতন্ত্রের মুখ্য উদ্দেশ্য সাম্য। গণতন্ত্রে ব্যক্তির মূল্য ও মর্যাদা নিশ্চিত করা হয়। গণতন্ত্র শব্দটির অর্থ জনগণের ক্ষমতা। অর্থাৎ, সরকার বা শাসন ব্যবস্থা যখন জনগণের স্বার্থ ও অভিমতের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, তখন তাকে গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বলে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন তার গেটিসবার্গ ভাষণে বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা গঠিত সরকার, জনগণের জন্য সরকার।’ গণতন্ত্রহীন দেশে অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে এবং এ কারণে উন্নয়ন ব্যাহত হতে পারে। অন্যদিকে, দুর্নীতির ব্যাপক উপস্থিতি উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। বিশেষ করে দুর্নীতির কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল ন্যায্যতার ভিত্তিতে জনগণ ভোগ করতে পারে না।

উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তবে সবার আগে দরকার গণতন্ত্র। গণতন্ত্র থাকলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক উন্নয়ন মূলত প্রবাসী বাংলাদেশি, পোশাক খাতে কর্মরত শ্রমিক এবং কৃষকের অবদানেই গঠিত। তাদের পরিশ্রমের ফলেই মূলত দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ খাতগুলো নানা ত্রুটি-বিচ্যুতিতে জর্জরিত। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্বাধীনতা-পরবর্তী অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন দলের উন্নয়নের তরিকা ও নীতি-নির্ধারণের ধারা আমরা দেখেছি। কিন্তু মানুষের অধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে আছি। এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার। তৃতীয় কোনো গণতান্ত্রিক দলের আগমন হলে হয়তো অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে।

দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ও উন্নয়নের প্রাথমিক শর্তগুলো অর্থনীতিবিদেরা যথাযথভাবেই চিহ্নিত করেছেন। আমরা যদি তাদের বক্তব্যের সঙ্গে মিলিয়ে বিদ্যমান বাস্তব চিত্র দেখার চেষ্টা করি তাহলে দেখতে পাব, দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র কার্যকর বিরাজ করছে না। একটি দলের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদও কার্যত একদলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সর্বব্যাপী দলীয়করণের মাধ্যমে জনপ্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসনসহ রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে দলীয় লেজুড়ে পরিণত করা হয়েছে। গণতন্ত্রের উচ্চতর মানের প্রসঙ্গ তো দূরের কথা, প্রাথমিক যেসব অধিকার মানুষের থাকার কথা (যেমন, বাকস্বাধীনতা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বিশ্বাস নির্বিশেষে প্রত্যেকেরই কাজের বা চাকরির সুযোগ পাওয়ার স্বাধীনতা প্রভৃতি) তা কোনো কিছুই বর্তমান বাংলাদেশে প্রায় নেই বললেই চলে।

সরকারের কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও জনগণের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় শাসনকাজ পরিচালনা করাই হচ্ছে সুশাসন। সুশাসন এমন এক কাক্সিক্ষত শাসন ব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে আইনের শাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, বাকস্বাধীনতাসহ সব রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতার সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকে। সুশাসন থাকলে শাসনকার্যে জন অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়, অর্থাৎ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পাশাপাশি জাতি-ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার অধিকারের সুরক্ষা থাকবে এবং সরকার জনগণের চাহিদার প্রতি সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল থাকবে।

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী ও মজবুত করার জন্য সুশাসন নিশ্চিত করা দরকার। বর্তমানে সুশাসনের অভাবে ভুগছে ব্যাংক খাতও। খেলাপি ঋণ ও হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের কারণে দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম ব্যাংক খাত। রাজনৈতিক বিবেচনায় একের পর এক ব্যাংকের অনুমোদন দিয়ে দুস্থ ব্যাংকের জন্ম দেয়া হয়েছে। ফলে পুরো ব্যাংক খাতের ওপর জনগণের আস্থা বিনষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকগুলো শিল্প খাতে ঋণদানের সক্ষমতা হারিয়েছে। গ্রামীণ শিল্প খাতের অবস্থাও নাজুক।

সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলার সুযোগ নেই। সুশাসন ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় অন্যতম অন্তরায় হচ্ছে বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। ফলে জনগণ স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারে না, যা সুশাসন প্রতিষ্ঠাকে বাধাগ্রস্ত করে। আবার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব ও সহিংসতার কারণেও সুশাসন ব্যাহত হয়। এছাড়া অধিকাংশ দেশেই আইনের শাসন কার্যকর থাকে না। আইনের শাসনের অভাবের কারণে সুশাসন বিঘ্নিত হয়। সরকারের অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনা কিংবা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে দেশে অরাজকতা দেখা দেয়। এতেও ব্যাহত হয় সুশাসন। দুর্নীতির কারণে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নৈতিকতা চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করা হয়। ন্যায়বিচার, সাম্য ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হুমকির মুখে পড়ে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র চর্চার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। ক্ষমতায় যাওয়ার পর নেতারা যেসব স্বৈরাচারী আচরণ করেন তাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ থাকে না। এছাড়া রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ, স্বজনপ্রীতি, দুর্বল আইন বিভাগ, আমলাতন্ত্রের অদক্ষতাসহ বিভিন্ন কারণে সুশাসন প্রতিষ্ঠা বাধাগ্রস্ত হয়।

উন্নয়ন ও সুশাসনের পূর্বশর্ত হচ্ছে গণতন্ত্র। গণতন্ত্রে জনপ্রতিনিধিরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয় বলে সরকারের ওপর জনগণের এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকে। এতে জনগণের ক্ষমতায়ন ঘটে এবং সরকার জনমত ও জনকল্যাণকে প্রাধান্য দিতে বাধ্য হয় বলে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সুশাসনের অন্য একটি অপরিহার্য উপাদান হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। আইনের শাসন নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য দূর করে, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও নাগরিকের অধিকার রক্ষা করে। ফলে সুশাসনের পথ সুগম হয়। সুশাসনের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো জবাবদিহি। নিজের কাজের জন্য অন্য ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যাদানের বাধ্যকতাই জবাবদিহি। সর্বস্তরে জবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলে দুর্নীতি কমবে এবং এর সঙ্গে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হ্রাস পাবে। স্বচ্ছতা সুশাসনের অন্যতম প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য। যেকোনো ধরনের গোপনীয়তা পরিহার করে নিয়মনীতি মেনে কোনো কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করাই স্বচ্ছতা। দক্ষতা সুশাসনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের দক্ষতা আবশ্যক।

আইনের শাসন বলতে আইনের চোখে সবাই সমান এবং সবকিছুর ওপরে আইনের প্রাধান্যের স্বীকৃতিকে বোঝায়। আইনের শাসনের অর্থ হচ্ছে ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি এবং ছোট-বড় নির্বিশেষে সবাই আইনের কাছে সমান। আইন ভঙ্গ করলে সে যেই হোক না কেন তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হবে। এটাই আইনের শাসনের বিধান। দেশে অনেক বড় বড় অবকাঠামোগত উন্নয়নমূলক কাজ দৃশ্যমান হয়েছে। পাশাপাশি দুর্নীতি অসততা ঘুষ অদক্ষতায় দেশ সয়লাব। রাজনীতি এখন এক ধরনের দুর্বৃত্তায়ন। ষাটের দশকে মেধাবী ছাত্ররা রাজনীতি করত। তারা বিরোধী রাজনীতি করলেও পরস্পরের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। ভিন্নমতের প্রতি ছিল শ্রদ্ধাবোধ। তাই দুই দলের দুজন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে তখন নিবিড় বন্ধুত্ব হওয়া ছিল খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এখন আর সেদিন নেই। অন্য দল করা মানেই জাতশক্র। এই মনোভাব বিধ্বংসী। এই মনোভাব থাকলে কখনোই গণতন্ত্রের চর্চা হয় না।

উত্তরাধিকারের রাজনীতি, ভোট গ্রহণ ও প্রদানে অস্বচ্ছতা, ক্ষমতার বলয়ে থাকা মানুষের দর্পিত আচরণ ও বিচারহীনতা জনগণকে ক্রমান্বয়ে কোণঠাসা করে ফেলছে। একের পর এক সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। জনগণ  সেসব সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। নেই কোনো গণশুনানির ব্যবস্থা। জনগণ কী চায়, যা তাদের ওপর চাপানো হচ্ছে তা আদৌ চায় কিনা এসব কথা বলার সুযোগ নেই। তাই গণতন্ত্রের প্রশ্নে আজ সারা দেশ দ্বিধাবিভক্ত। অনেকে মনে করেন, গণতন্ত্র একটা মুুখরোচক গালভরা শব্দমাত্র। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে গণতন্ত্র বা জনগণের শাসন বলে কিছু নেই। আসলে জনগণের নামে গুটিকয়েক ব্যক্তিই রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। যদি ভোট হয় তাহলে জনগণের অধিকার শুধু ভোট দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। ভোটের পর শাসনকার্য পরিচালনায় জনগণের কোনো ভূমিকা আছে বলে তারা মনে করেন না। বিশেষজ্ঞদের মতে গণতন্ত্র এমন একটি সরকার যেখানে প্রত্যেকের অংশগ্রহণ রয়েছে। কিন্তু এই অংশগ্রহণ কথাটাও এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।

সমস্যা হচ্ছে আমরা ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নই। অশ্রদ্ধা দেখাতে গিয়ে আমরা আমাদের অধিকারের আওতায় সীমাবদ্ধ রাখছি না। পরস্পরের দোষ ধরা, খুঁত ধরা এখন আর আমাদের ব্যক্তি-চরিত্র নয়, জাতীয়-চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে বিরোধীরা তাদের ভালো দিকগুলো বেমালুম চেপে যাচ্ছে। খারাপের তালিকা দীর্ঘতর হচ্ছে। আবার বিরোধীদের সমালোচনা করতে গিয়ে সরকার তাদের কিছুই ভালো দেখছে না, মারমুখী ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। পরস্পরের এই যুদ্ধংদেহী অবস্থানের কারণে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন হচ্ছে না। জনগণ হয়ে পড়ছে অসহায়, দিশেহারা। পারস্পরিক সহযোগিতা সহমর্মিতার অভাবে কারও কোনো অর্জনই প্রশংসা পাচ্ছে না। এটা গণতন্ত্রের চরিত্র নয়। তবে দেশে বর্তমানে কোনো রাজনৈতিক সংলাপ হচ্ছে না। সরকার ভিন্নমত সহ্য করছে না। তাই গণতন্ত্রও পুরোপুরি বিকশিত হচ্ছে না। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পর এখনও আমাদের গণতন্ত্র আছে কিনাÑ সে প্রশ্ন তুলতে হচ্ছে। ভিন্নমত কতটা জরুরি এ বিষয়ে যে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতে হচ্ছেÑএটাই দুঃখের ব্যাপার।

ব্যাংকার