উন্নয়নে সঠিক কাঠামোগত রূপান্তর প্রয়োজন

সুমাইয়া বিনতে হোসাইন : অর্থনীতির ভাষায় স্ট্রাকচারাল চেঞ্জ তথা কাঠামোগত রূপান্তর বলতে বোঝায় একটা কম উৎপাদনশীল খাত থেকে অধিক উৎপাদনশীল খাতে স্থানান্তরিত হওয়া, যার ফলে একটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। কাঠামোগত রূপান্তর যদি জিডিপির ক্ষেত্রে দেখি, তাহলে তিনটি ভাগ দেখা যায়। যার প্রথমটা হলো কৃষি খাত, যেখানে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশ নেপাল, পাকিস্তান, ভারত ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান দিন দিন কমছে। যদিও নেপাল আর পাকিস্তানের দিকে তাকালে দেখা যায়, কৃষি খাতের অবদান এখনও অধিক, যথাক্রমে ৩০ শতাংশ এবং ২৮ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশে এ খাতের অবদান এখন ১১-১২ শতাংশ, ভারতে ১৩-১৪ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় ১০ শতাংশেরও কম। আর দ্বিতীয় খাত হলো শিল্প খাত, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশেরই জিডিপিতে একটা ভালো আকারের অবদান দেখা গেলেও নেপাল আর পাকিস্তানে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের শেয়ার খুবই কম। অন্যদিকে বাংলাদেশে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের একটাই খাত, যেখানে ভূমিকা পালন করছে পোশাকশিল্প, যার অর্থ পোশাকশিল্পে কোনোভাবে ধস নামলে বাংলাদেশ নড়েচড়ে উঠবে। কেননা এ খাত বিদেশি কারেন্সি আয়ের একটা মূল হাতিয়ার। তৃতীয় খাতটি হলো সেবা খাত, যার অবদান জিডিপিতে বেড়েই চলেছে, কিন্তু এটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ কেননা এ খাতে কাঠামোগত রূপান্তর সঠিকভাবে হচ্ছে না, কারণ মানুষ নি¤œ আয়ের কাজ ছেড়ে আবার নি¤œ আয়ের কাজেই যোগ দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশের যে মানুষ গ্রামে কৃষিকাজ করত, সে শহরে এসে রিকশাচালকের কাজ গ্রহণ করছে। কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকার মতো দেশে দেখা যায়, মানুষজন গ্রাম থেকে শহরে এসে শিল্পকারখানায় যোগদান করছে, যার ফলে সেবা খাতটা অধিক প্রভাব ফেলছে এবং সেসব দেশে ম্যাচিউর ডি-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন তথা পরিপক্ব অ-উদ্যোগীকরণ সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হওয়ায় দেশ উন্নতির দিকে এগোচ্ছে। এখন প্রিমেচিউর ডি-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন হলো খুব কম পার ক্যাপিটা ইনকামে ম্যানুফ্যাকচারিং বা শিল্প খাতের, জিডিপিতে অবদান কমে যাওয়া এবং সেবা খাতের অবদান বাড়তে থাকা। মালেশিয়ায় দেখা যায়, তাদের পার ক্যাপিটা ইনকাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জিডিপিতে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অবদান বেড়েছে এবং একটা পর্যায়ে এর অবদান কমেছে, যা অধিক মেচিউর কেননা কিছু দিনেই তারা উচ্চ ইনকামে পৌঁছে যাবে, আর এরই মধ্যে তাদের সেবা খাত অন্যান্য খাতের চেয়ে অধিক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে এই দৃশ্য সম্পূর্ণ বিপরীত হলেও বাংলাদেশে যদিও পোশাক খাতের কারণে ম্যানুফ্যাকচারিং খাত ভালোভাবে টিকে আছে, কিন্তু এ খাতে শ্রমিকদের কর্মসংস্থান নিয়ে এখনও বড় ধরনের সমস্যা আছে। যদিও কৃষি খাতের অবদান জিডিপিতে কমছে, কিন্তু এখনও এ খাতে জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ শ্রমিক নিয়োজিত আছে বাংলাদেশে, ৪০ শতাংশের বেশি নিয়োজিত আছে ভারতে, আর নেপালে ৭০ শতাংশের মতো শ্রমিক এ খাতে আটকে আছে। অর্থনীতিতে যার অর্থ, যেখানে অধিক জনবল নিয়োজিত থেকে কাজ করে তা কম প্রোডাকটিভ/উৎপাদনশীল হয়, আর যে খাতে কম লোক থাকে, সে খাতে অধিক উৎপাদন হয়। এর অর্থ কৃষি খাত থেকে অধিক শ্রমিককে বাদ দিলে তা আরও প্রোডাকটিভ হয়ে উঠবে। জিডিপিতে বাণিজ্যের অবদানের দিকে স্ট্রাকচারাল চেঞ্জ লক্ষ করলে দেখা যায়, এর অবদান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় কম পার ক্যাপিটা ইনকামে বাণিজ্যের অবদান পতিত হওয়া শুরু করেছে, যা একটা বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয়। বাংলাদেশের রপ্তানিযোগ্য পণ্যের ঝুড়ি বৈচিত্র্যময় করতে হবে, যেমনটা দেখা যায় ভিয়েতনামের মতো দেশে। আবার জিডিপিতে  এফডিআইয়ের (ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট) অবদান দুই শতাংশেরও কম দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয়, কিন্তু ভিয়েতনামে এর শেয়ার দেখা যায় পাঁচ-ছয় শতাংশ, যা বাংলাদেশে এক শতাংশেরও কম, যেটা একটা দেশের উন্নয়নের পেছনে একটা বড় ধরনের উদ্বেগের সৃষ্টি করে। এখন এসব সমস্যার সমাধান না করতে পারলে দেশের স্ট্রাকচারাল চেঞ্জ সঠিকভাবে হবে না, ফলে একটা দেশ বেকারত্ব, দারিদ্র্যসহ নানা ধরনের সমস্যায় ঘুরপাক খেতে থাকবে। সুতরাং এসব সমস্যার সমাধানে প্রথমত সরকারের বাণিজ্য নীতিমালা, এফডিআই ও শিল্প খাতের নীতিমালার সঙ্গে ম্যাক্রো নীতিমালা যথাযথ কি না দেখতে হবে, কর্মসংস্থানের জন্য পর্যাপ্ত তথ্য, প্রশিক্ষণ ও সুযোগের সৃষ্টি করতে হবে, দেশের নাগরিকরা নিজ দেশে যাতে বিনিয়োগ করে, তাতে উৎসাহিত করতে হবে, কেননা অন্যান্য দেশ যখন বাইরের দেশে বিনিয়োগ করতে যায়, সেক্ষেত্রে বাইরের দেশের নিজ নাগরিকদের বিনিয়োগ কেমন তা পর্যালোচনা করে রপ্তানি পণ্যতে ভিন্নতা তথা রপ্তানি পণ্যের ঝুড়িতে ভিন্নতা আনতে হবে, উৎপাদক শ্রেণির পণ্য সরবরাহে সব দিকে কম খরচসহ সব সুবিধা নিশ্চিত করা, বুরোক্রেসি, ল অ্যান্ড অর্ডার এসব প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে পরিচালনা করা এবং সর্বোপরি মানবসম্পদ গড়ে তোলার মাধ্যমে স্ট্রাকচারাল চেঞ্জ বা কাঠামোগত রূপান্তর সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে একটা দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত হবে।

শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়