আফিয়া সুলতানা: ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’। আজকের শিশুই দেশ-জাতির আগামী দিনের কর্ণধার। আজকের শিশুরাই আগামী দিনে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবে। কোমলমতি শিশুরা খেলাধুলা করবে, স্বাধীনভাবে পড়াশোনা করবে, মৌলিক চাহিদাগুলো পরিবার তথা সমাজ পূরণ করবে এটাই সামাজিক নিয়ম। তা শর্তেও বাস্তবতায় কিছু শিশুকে দেখা যায় ভিন্ন প্রেক্ষাপটে শিশু শ্রমিক হিসেবে। যারা নানা কারণে উপযুক্ত পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জীবিকার তাগিতে বাধ্য হচ্ছে শ্রম দানে। বর্তমানে অনেক শিশুর শৈশব ও বিকশিত জীবনে অন্তরায় শিশুশ্রম। যে সময়ে তাদের ব্যাগ হাতে স্কুলে যাওয়ার কথা সেই সময়েই তারা বহন করছে জীবিকার ভার।
শিশুশ্রম বলতে বোঝানো হয়, সাধারণত শিশুদের উপযোগী নয় জীবন ও জীবিকার তাগিতে শিশুদের এমন কাজ করতে বাধ্য হওয়া। শিশুশ্রমিকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি অংশ গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশু। শিশুশ্রম মানবাধিকার ভঙ্গের এক নিকৃষ্ট প্রথা। দরিদ্র পরিবারের সন্তান বা পথশিশুরা আর্থিক অসহায়ত্বের জন্য শিশুশ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হয়। শিশুশ্রমিকদের ৭৫ শতাংশই গৃহকর্মে নিয়োজিত হয়। আবার তাদের মাঝে অধিকাংশই মেয়ে শিশু। শিশুশ্রম শিশুদের জীবনে একটা অমানবিক অধ্যায়।
দেশের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে যখন জীবন ধারণ ব্যয় উপার্জন করা দুরূহ হয়ে পড়ে তখন দরিদ্র মানুষ বাধ্য হয়ে বাড়তি উপার্জনের জন্য তাদের সন্তানদের ঝুঁকিপূর্ণ নানা কাজে নিয়োজিত করে। শুধু গৃহকর্মী হিসেবেই নয়, শিশুরা শ্রম দিচ্ছে হোটেল, চায়ের দোকানে, কারখানায়, রেস্টুরেন্টে কখনোবা রাস্তায় হকারি করে। অর্থাৎ আর্থসামাজিক পরিস্থিতির কারণে শিশুদের উল্লেখযোগ্য অংশ শ্রমিক হিসেবে নিয়োগে বাধ্য হয়। শিশুশ্রম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে আরও দায়ী আছে রাজনৈতিক বিপর্যয়, উদ্বাস্তু জীবনের ছিন্নমূলতা, অভিভাবকদের অমানবিক আচরণ, মাতা-পিতার পঙ্গুত্ব প্রভৃতি। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক কার্যক্রম বিঘিœত হওয়ায় এবং লকডাউনে শিশুরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ে এবং জীবিকার সন্ধানে শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত হয়।
আইএলওর হিসাব অনুসারে পৃথিবীতে নিযুক্ত রয়েছে প্রায় ২৪ কোটি ৬০ লাখ শিশু। এদের মধ্যে দশ বছর বয়সী বা তার কম শিশুর সংখ্যা ৭ কোটি ৩০ লাখ। অর্থাৎ বিশ্বের প্রতি ৬ জন শিশুর মধ্যে একজন শিশুশ্রমে নিযুক্ত আছে। বাংলাদেশেও সেই শ্রমের মাত্রা উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৩ সালের শিশুশ্রম জরিপের প্রতিবেদন অনুসারে দেশে তখন প্রায় ১৭ লাখ শিশু শ্রমিক ছিল, যা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৭ সালের আইএলওর সর্বজনীন সামাজিক প্রতিবেদন অনুযায়ী পৃথিবীর ৯০ কোটি চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্ধেকই শিশু। অর্থাৎ দরিদ্র পরিবারে শিশুর জš§হার অধিক। ফলে অভিভাবক শিশুদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে না পারায় শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেয়। আবার বিপিএসের ২০১৩ সালের তথ্য অনুযায়ী দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী সাড়ে ৩৪ লাখ শিশু কাজের নিযুক্ত আছে। যার প্রায় ৫০ শতাংশ শিশু। অন্য একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুর বয়স ৫ থেকে ১১ বছর যাদের উল্লেখযোগ্য অংশ গৃহকর্মে নিয়োজিত। শিশুর স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও নৈতিকতার ক্ষতি করতে পারে এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুসংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৬ সালের পর ৬৫ লাখ বেড়ে ২০২১ সালে তা ৭ কোটি ৯০ লাখে পৌঁছেছে। আইএলওর মহাপরিচালক গাই রাইডার বলেন, নতুন এই হিসাব একটি সতর্ক সংকেত। যখন নতুন একটি প্রজন্মের শিশুদের ঝুঁকিতে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। শিশুশ্রমিকের এই সংখ্যা দাঁড়ায় মোট জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং কাজের নিযুক্ত শিশুর সংখ্যা ৪৯৪ দশমিক ৩ শতাংশ। একটি টেলিভিশন চ্যানেলের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০১৩ সালে ১২ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে জড়িত ছিল। যার মধ্যে গৃহ কাজে নিযুক্ত শিশুশ্রম অন্যতম। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে অতিরিক্ত ৯০ লাখ শিশু ঝুঁকিতে পড়ার বিষয়ে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ও ইউনিসেফ। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে আরও লাখ লাখ শিশু ঝুঁকিতে রয়েছে। যদিও শিশুশ্রমে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে অগ্রগতি হলেও মাঝেমধ্যেই ঘটছে বেদনাদায়ক দুর্ঘটনা। তবে সমবয়সী শিশুদের মধ্যে মেয়েদের তুুলনায় ছেলে শিশুদের শিশুশ্রমে নিযুক্ত হওয়ার হার বেশি। কিন্তু গৃহকর্মী হিসেবে মেয়ে শিশুদের নিযুক্ত হওয়ার হার অধিক। সপ্তাহে অন্তত ২১ ঘণ্টা গৃহস্থালি কাজে সম্পৃক্ত থাকে এমন শিশুদের বিবেচনায় নিলে শিশুশ্রমে যুক্ত সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, গ্রামাঞ্চলে শিশুদের গৃহকর্মের শ্রমের নিযুক্ত হওয়ার হার (১৪ শতাংশ) যা শহরাঞ্চলের (৫ শতাংশ) এর তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি।
গৃহকর্মে বা অন্যান্য কাজে শিশুশ্রমিকদের অত্যন্ত কম পারিশ্রমিকে নিয়োজিত করা হয়। মাঝেমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য গৃহ কাজে নিয়োজিত শিশুদের প্রতি অমানবিক আচরণ, বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন, হত্যা কিংবা আত্মহত্যার ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। নিয়োগকর্তার শাসনে অনেকের মৃত্যুও হয়েছে। শ্রমে নিয়োজিত শিশুরা শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির ঝুঁকিতে থাকে। শারীরিকভাবে তাদের দুর্বল করে দেয়। গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের স্বাস্থ্য দুর্বল থাকায় তারা সুষম খাদ্যের অভাবে পুষ্টিহীনতায় ভোগে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। শিশুরা পারিবারিক অভাব-অনটন, নির্যাতন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে শহরগুলোতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজের জন্য আসে কিন্তু তাদের সইতে হয় অবহেলা, নির্যাতন ও শোষণ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা নিয়োগকর্তার ভালোবাসা ও সহানুভূতি থেকে বঞ্চিত হয়। নিয়োগকর্তা থেকেও তারা পুষ্টিকর
খাবার, শিক্ষা ও মানসম্মত বস্ত্রের সংস্থান করতে পারে না। থাকতে হয় জরাজীর্ণভাবে। ফলে তারা অপুষ্টি ও নানা রোগে ভোগে অমানবিক জীবনযাপন করে থাকে। বাংলাদেশে গৃহকর্মে নিয়োজিত মেয়ে শিশু এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছেলে শিশুরাও যৌন নির্যাতন ও মারধরের শিকার হয় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। কখনও কখনও কাজে ভুলত্রুটি ধরা পড়লে গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের গায়ে গরম পানি ঢেলে কিংবা গরম খুন্তি দিয়ে নির্যাতন করার খার প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে।
সংবিধানের ৩৪নং অনুচ্ছেদে শিশুদের অধিকার রক্ষার কথা বলা হলেও সংবিধানকে উপেক্ষা করে শিশুদের স্বল্প মজুরিতে জোর করে কাজ করিয়ে নেয়া হচ্ছে। শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে বিরত রাখতে ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ ঘোষণা করে। শিশু অধিকার সনদ ১৯৮৯-এর উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এক. শিশুর অধিকার বাস্তবায়ন; দুই.পরিচয় সংরক্ষণ; তিন. মতপ্রকাশের স্বাধীনতা; চার. সামাজিক নিরাপত্তা; পাঁচ. শিশু স্বাস্থ্যের প্রাধান্য; ছয়. বৈষম্যহীনতা; সাত. অবৈধ স্থানান্তর রোধ; আট. অক্ষম ও উদ্বাস্তু শিশু অধিকার সংরক্ষণ; নয়. সামাজিক পর্যালোচনা; দশ. মাতাপিতার সঙ্গে অবস্থানের অধিকার প্রভৃতি। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো সনদ অনুসরণ করতে পারলেও আর্থ-সামাজিক দুরবস্থার জন্য বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো অনুসরণ করতে পারছে না। শিশুশ্রম নিরসনে সচেতনতায় প্রতি বছর ১২ জুন পালিত হয় বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। বাংলাদেশেও গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫ পর্যালোচনার মাধ্যমে এর সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। গত ২৪ আগস্ট রাজধানীর ডেইলি স্টার ভবনে অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট (এএসডি) আয়োজিত ডেভেলপমেন্ট অব চিলড্রেন অ্যাট হাই রিস্ক (ডিসিএইচআর) প্রকল্পের উদ্যোগে নিয়োজিত শিশুর অধিকার ও সুরক্ষা; সরকারের উদ্যোগ শীর্ষক এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে উপস্থিত হাসিনা আক্তার বলেন, গৃহকর্মে নিযুক্ত শিশুর নিয়োগকর্তার প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। তারা কীভাবে গৃহকর্মীদের সঙ্গে আচরণ করবেন। ব্রেড ফর দ্য ওয়ার্ল্ড জার্মানির সহযোগিতায় ডেভেলপমেন্ট অব চিলড্রেন অ্যাট হাই রিস্ক (ডিসিএইচআর) প্রকল্পটির আওতায় ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের সুরক্ষা নিয়েও কাজ করে আসছে। এএসডি বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা যেটি ১৯৮৮ সাল থেকে শিশুর সুরক্ষা নিয়ে কাজ করে আসছে।
বিশিষ্টজনরা মনে করেন, গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। শিশুশ্রম বা গৃহ শিশুশ্রম বন্ধে শুধু সরকার নয়, সবার ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি প্রয়োজন। গৃহ শিশুশ্রম নিরসনে শিশুদের পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে সহায়তা করা প্রয়োজন। শিশুদের সুরক্ষায় বঙ্গবন্ধু উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যার ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশুবান্ধব আইন নীতিমালা সংশোধন ও পরিমার্জন করেছেন। এই বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। শিশুদের জন্য আলাদা অধিদপ্তর ঘটনার বিষয়েও প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়েছে। গৃহ শিশুশ্রমিকদের জন্য আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু আর্থসামাজিক দুরবস্থা, মাঠপর্যায়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, বাজেট ব্যয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অভাব, দীর্ঘসূত্রতায় তা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। বন্ধ হচ্ছে না শিশুশ্রম ? আইন অনুসারে শিশু গৃহকর্ম পেশা হিসেবে স্বীকৃত না হলেও বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। শিশুশ্রম নিরসনে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সুরক্ষা ও টেকসই উন্নয়ন এসডিজির (লক্ষ্যমাত্রা) অর্জনে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। শিশুদের আর্থিক সহায়তায় শিশু সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়গুলোর বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। শিশুদের অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়োগকর্তার সুসম্পর্ক থাকতে হবে। করোনাতে বন্ধ থাকা শিশুদের বাজেট পুনরায় চালু করে তার যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। আসুন সচেতনতা তৈরি করি, শিশু কল্যাণে কাজ করি, গৃহকর্মে শিশুশ্রমকে না বলি।
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়