চুক্তির সুযোগ নিচ্ছে রেন্টাল ও আইপিপিগুলো

উৎপাদন বন্ধ থাকলেও ৬ মাসের পুরো ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে

ইসমাইল আলী: জ্বালানি সংকটে গত জুলাই থেকে কমিয়ে দেয়া হয় বিদ্যুৎ উৎপাদন। এ সময় বেশকিছু রেন্টাল ও আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) কেন্দ্র বন্ধ রাখে মালিকরা। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা হয়নি বিদ্যুৎ। তবে বেসরকারি এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির শর্তের কারণে ক্যাপাসিটি চার্জ বা জরিমানা কাটতে পারছে না বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের পুরো ক্যাপাসিটি চার্জই দিতে হচ্ছে। সম্প্রতি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিডিবি।

সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে ৪৩ শতাংশ। এ সময় ডলার সংকটে বেসরকারি বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারেনি। ফলে বন্ধ ছিল বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন। আবার সরকার ভর্তুকির অর্থ নিয়মিত ছাড় না করায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিল নিয়মিত পরিশোধ করা যায়নি। এ কারণেও বিভিন্ন সময় বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়। তবে উৎপাদন বন্ধ থাকলেও এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ কাটা যাবে না।

যদিও এর আগে বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদনহীন বন্ধ রাখা ও চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ না দিতে পারার জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পিডিবি। তবে পিডিবির এ সিদ্ধান্তে আপত্তি জানায় বিপ্পা (বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস’ অ্যাসোসিয়েশন)। এ সময় বিপ্পা জানায়, চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসের বিল পরবর্তী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সরকারকে পরিশোধ করতে হবে। তাতে ব্যর্থ হলে মালিকরা চাইলে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে পারবে। তবে এজন্য কোনো ধরনের জরিমানা বা ক্যাপাসিটি চার্জ কর্তন করা যাবে না। বিপ্পার আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য হয় পিডিবি।

তথ্যমতে, গত ২৫ সেপ্টেম্বর ও ১৬ নভেম্বর বিপ্পা থেকে পিডিবিতে দুটি চিঠি দেয়া হয়। এগুলোয় জানায় হয়, নির্ধারিত তারিখের মধ্যে বিপ্পা সদস্য কোম্পানিগুলোর মাসিক বিল পরিশোধে পিডিবি ব্যর্থ হয়। পিপিএ (বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি) অনুযায়ী পিডিবি থেকে এলসি প্রদানে ব্যর্থ হওয়ায় কোম্পানিগুলোর বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেল আমদানি করতে পারেনি। ফলে রেশনিং করে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালাতে হয়েছে। এজন্য ১ মে বিপ্পা থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর আউটেজ (উৎপাদন বন্ধ রাখা) গণনা বন্ধ রাখার অনুরোধ করা হয়েছিল।

চিঠিতে আরও বলা হয়, পিডিবি ও বিপ্পার সদস্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে স্বাক্ষরিত পিপিএর সেকশন ১৩.২(জে) অনুযায়ী, কোম্পানি কর্তৃক মাসিক বিল দাখিলের ৩০ দিন পরবর্তী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে পিডিবি বিল পরিশোধ না করলে কোম্পানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ডিপেনডেবল ক্যাপাসিটিতে বিদ্যুৎ সরবরাহে বাধ্য থাকবে না। সেক্ষেত্রে ওই সময়ে কোম্পানি পূর্ণ ক্যাপাসিটি চার্জ প্রাপ্য হবে।

বিপ্পার আবেদন পর্যালোচনা করে পিডিবি জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে পিডিবি থেকে আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিল পরিশোধে বিলম্ব হওয়ায় এ কোম্পানিগুলো তারল্য সংকটে পড়েছে এবং জ্বালানি তেল আমদানির জন্য এলসি খোলা ও সেটেলমেন্টে বিলম্ব হওয়ায় অধিক সুদের হার আরোপিত হচ্ছে। এছাড়া যথাসময়ে নতুন করে এলসি খোলাও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেল আমদানি করতে না পারায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে আউটেজে (১০ শতাংশের বেশি সময় উৎপাদন বন্ধ) পড়তে হচ্ছে। অন্যদিকে বিদ্যমান ডলার সংকটের কারণেও নতুন করে জ্বালানি তেল আমদানির জন্য এলসি খোলা বিলম্বিত হচ্ছে।

২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত পিডিবি থেকে সব বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এছাড়া জুনের আংশিক বিল পরিশোধ করা হয়েছে। অবশিষ্ট বিল পরিশোধের প্রক্রিয়া চলমান আছে। আর চুক্তি অনুযায়ী বর্তমানে জুনের আংশিক, জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের পুরো বিল বকেয়া আছে। আবার কোম্পানিগুলোর এলসি বিল বাবদ অর্থ এনক্যাশ করেনি পিডিবি। এছাড়া এলসি বিল পরিশোধ না করায় সরকারের গ্যারান্টিও ইস্যু করা হয়নি।

এ অবস্থায় ফার্নেস অয়েলচালিত আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে বেশকিছু সমস্যা তুলে ধরে। এর মধ্যে রয়েছে, বিশ্ববাজারে ফার্নেস অয়েলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় জ্বালানি ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ভর্তুকির অর্থ ছাড় না করায় বিল পরিশোধ বিলম্বিত হচ্ছে, ফার্নেস অয়েল আমদানিতে এলসি খোলা ও সেটেলমেন্ট বিলম্বিত হচ্ছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পরিচালনার জন্য লুবওয়েল ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানিতে সমস্যা হচ্ছে, টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য বৃদ্ধিতে ও ডলার সংকটের কারণে ডলার পেমেন্ট বিলম্বিত হচ্ছে, পুরোনো এলসি সেটেল না করতে পারায় কোম্পানিগুলোর সিঙ্গেল বরোয়ার এক্সপোজার লিমিট অতিক্রম করেছে। এতে নতুন এলসি খোলা যাচ্ছে না এবং বিদেশি ব্যাংকগুলো এলসি কনফার্ম করতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছে।

পিডিবি আরও জানায়, এর আগে কোম্পানিগুলোর মাসিক বিল সাধারণত দুই মাস পরে প্রদান করত পিডিবি। গ্যাস সরবরাহে অপ্রতুলতার কারণে তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বেশি পরিচালনা করতে হচ্ছে। অথচ তাদের বিল নিয়মিত পরিশোধ করা হচ্ছে না। তাই চুক্তি মোতাবেক কোম্পানিগুলোর বিল পরিশোধ করতে না পারায় বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর তারল্য সংকটে পড়ার বিষয়ে পিডিবি বোর্ড সভায় আলোচনা করা হয়। তাই অতিরিক্ত আউটেজের জন্য লিকুইডেটেড ডেমারেজ বাবদ অর্থ কাটা হলে কোম্পানিগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হবে বলে বোর্ডসভায় মতামত ব্যক্ত করা হয়। তাই জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্যাপাসিটি চার্জ কাটার সিদ্ধান্ত  স্থগিত করা হয়।

জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনায় শুধু ফার্নেস অয়েলচালিত সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য জুলাই ’২২ থেকে ডিসেম্বর ’২২ পর্যন্ত অতিরিক্ত আউটেজের বিপরীতে লিকুইডেটেড ডেমারেজ না কাটা বা অ্যাভেইলেবল ফ্যাক্টর বিবেচনায় ক্যাপাসিটি চার্জ হ্রাস না করার সাময়িক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।