নজরদারিতে বেক্সিমকো গ্রুপ

ঋণে জর্জর পাঁচ কোম্পানি তদন্তে নামছে বিএসইসি

নুরুন্নাহার চৌধুরী কলি : পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেক্সিমকো গ্রুপের তিনটি কোম্পানিসহ মোট পাঁচটি কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যাপক তদন্ত শুরু করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। দীর্ঘদিন ধরে এসব কোম্পানি বিপুল ঋণের বোঝা টানছে। এর মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি রয়েছে রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস ও নিউলাইন ক্লোথিংস।

চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিএসইসি, যাদের ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্তে দেখা হবে কোম্পানিগুলোর কারখানা ও অফিস পরিদর্শন, হিসাবপত্র, পরিচালক ও উদ্যোক্তাদের শেয়ার ধারণ, অভ্যন্তরীণ লেনদেন, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের কার্যক্রম এবং বার্ষিক সাধারণ সভাসহ অন্যান্য কার্যক্রমে কোনো অনিয়ম বা গাফিলতি রয়েছে কি না।

দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকো গ্রুপের ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এ বিপুল পরিমাণ ঋণের একটি বড় অংশ বর্তমানে মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। গ্রুপভুক্ত কোম্পানিগুলোর হালনাগাদ আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে এসব তথ্য জানা গেছে।

‘এ’ ক্যাটাগরির কোম্পানি বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত স্বল্পমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৪২৬ কোটি ৭৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ১৭৫ কোটি ৭৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ফলে কোম্পানিটির মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬০২ কোটি ৫৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা।

‘বি’ ক্যাটাগরির কোম্পানি বেক্সিমকো লিমিটেডের স্বল্পমেয়াদি ঋণ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১০৯ কোটি ১৭ লাখ ২০ হাজার টাকা, আর দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৩ হাজার ৩৪০ কোটি ৫১ লাখ টাকা। অর্থাৎ কোম্পানিটির মোট ঋণের পরিমাণ ৬ হাজার ৪৪৯ কোটি ৬৮ লাখ ২০ হাজার টাকা।

একই গ্রুপের ‘বি’ ক্যাটাগরির কোম্পানি শাইনপুকুর সিরামিকসের ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত স্বল্পমেয়াদি ঋণ ৯৭ কোটি ৫৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৯৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা। মোট ঋণের পরিমাণ ৯৮ কোটি ৫৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা।

‘জেড’ ক্যাটাগরির কোম্পানি রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলসের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত পাওয়া গেছে। সে সময় পর্যন্ত স্বল্পমেয়াদি ঋণ ছিল ৯৪ কোটি ৯৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৯৮ কোটি ৬৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। সবমিলিয়ে কোম্পানির মোট ঋণ ১৯৩ কোটি ৬৬ লাখ ৮০ হাজার টাকার বেশি। তবে ২০২১ সালের পর থেকে কোম্পানিটি কোনো আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।

‘জেড’ ক্যাটাগরির কোম্পানি নিউলাইন ক্লোথিংসের ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত স্বল্পমেয়াদি ঋণ ছিল ২১ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ছিল ৬৯ কোটি ৯১ লাখ ২০ হাজার টাকা। সর্বমোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। এই কোম্পানিরও ২০২১ সালের পর কোনো হালনাগাদ আর্থিক তথ্য পাওয়া যায়নি।

বিএসইসির বর্তমান কমিশন, চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয়। কোম্পানির শেয়ারধারণে অনিয়ম, ‘জেড’ ক্যাটাগরির কোম্পানিগুলোর স্বচ্ছতা ঘাটতি ও বার্ষিক সাধারণ সভা না করা-এসব বিষয়ে কড়া অবস্থান নেয়া হচ্ছে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষকদের মতে, এমন নজরদারি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে সাহায্য করবে। তবে ঋণের বিপুল বোঝা, অনিয়মের ইতিহাস ও আইনি জটিলতার কারণে বাজারে অনিশ্চয়তা থেকে যাবে। বিনিয়োগকারীদের উচিত গুজব নয়, সত্যিকারের তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া। পাঁচ কোম্পানির বিরুদ্ধে এই তদন্ত বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে একটি সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তদন্ত রিপোর্ট, আদালতের রায় এবং শেয়ার বিক্রির ফলাফল আগামী দিনগুলোয় বাজারের গতি-প্রকৃতিকে প্রভাবিত করতে পারে।