একটি দূরদর্শী সৃজনশীল উদ্যোগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর

 . মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: স্বপ্ন সত্য হওয়ার আনন্দ ও পরিতৃপ্তিই আলাদা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এমন একটি সৃজনশীল ও সফল শিল্পোদ্যোগের কথা বলা যায়, যা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবে। ত্রয়োদশ শতকে বিদেশি বণিকদের যে পথে  (বঙ্গোপসাগরের আদুরে কন্যা কর্ণফুলী নদীর মোহনা দিয়ে) যে অভিপ্রায়ে সমতটের এই ভূখণ্ডে প্রবেশ ঘটেছিল, তা ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য, ধর্ম ও সংস্কৃতি। বিগত সাত শতাব্দীর ইতিহাস সে প্রেক্ষাপটের ধারক ও বাহক। আধুনিক বাংলাদেশে সেই স্বাগতিক ঐতিহ্যের রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণ প্রয়াস-প্রত্যাশার স্বপ্ন পূরণের সফল উদ্যোগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। দেশের বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাই থেকে ১০ কিলোমিটার এবং বন্দরনগরী বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রামের মীরসরাই, সীতাকুণ্ড ও ফেনীর সোনাগাজীতে প্রায় ৩০ হাজার একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর হবে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রবেশদ্বার এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, শিল্পায়ন ও অর্থনীতির এক মহাজংশন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর (বিএসএমএসএন) হবে একটি অত্যাধুনিক শিল্পনগরী, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক ও শিল্প জোন।

এ শিল্পনগরে এরই মধ্যে দেশি-বিদেশি প্রায় ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব পেয়েছে বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। সরাসরি শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই), বেসরকারি উদ্যোগ এবং যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাব আসছে অব্যাহতভাবে। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকারের অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্পগুলোর অন্যতম। এটি নির্মিত হচ্ছে সাগরপাড়ে ইছাখালি, চরশরৎ, চর মোশাররফ ও সাধুর চর এলাকায়। দেশে ১০০টি ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে, তার মধ্যে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। প্রথমে মীরসরাই ইকোনমিক জোন হিসেবে কার্যক্রম শুরু করা হলেও এর সঙ্গে সীতাকুণ্ড ও ফেনীর সোনাগাজী অর্থনৈতিক অঞ্চল যুক্ত হয়ে বিশাল এলাকাজুড়ে এখন শিল্পনগর প্রতিষ্ঠার কর্মযজ্ঞ চলছে। তিনটি জোনকে একসঙ্গে নামকরণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বড়তাকিয়া থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে সাগরপাড়ে গড়ে ওঠা সমুদ্রবন্দর, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ সব ধরনের সুবিধা থাকবে বৃহৎ এই শিল্পাঞ্চলে। মহাসড়ক, নদী, সমুদ্র ও রেলপথে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের সঙ্গে সংযোগের অপূর্ব সুযোগ রয়েছে। তৈরি সম্পন্ন হলে প্রাথমিক পর্যায়ে অন্তত পাঁচ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। প্রাথমিকভাবে পাঁচ লাখ কর্মসংস্থানের টার্গেট থাকলেও অর্থনৈতিক অঞ্চল ৩০ হাজার একরে সম্প্রসারিত হলে সেখানে কমপক্ষে ১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব। ফলে দেশের অন্যান্য জেলার মানুষও এই জোনে কর্মসংস্থান ও জীবিকার সুযোগ পাবে। বলাবাহুল্য অবহেলিত এক চরাঞ্চল পরিণত হয়েছে শিল্পাঞ্চলে। স্থানীয়রাও এত বিপুলসংখ্যক শ্রমিক-কর্মচারীর আবাসনের কথা চিন্তা করে গড়ে তুলছে নানা ধরনের বাড়িঘর। সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা হওয়ায় বাঁধ ও পর্যাপ্ত সøুইস গেট নির্মিত হওয়ায় এখানে আর সমুদ্রের পানি প্রবেশ করে না।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বড়তাকিয়া থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেনের সড়ক। শিল্পনগরীর প্রবেশদ্বার বড় তাকিয়া হওয়ায় বড়তাকিয়া রেলস্টেশনটিরও আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেখানে যাত্রীসুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি নির্মিত হচ্ছে পণ্য পরিবহন ও সংরক্ষণের ইয়ার্ড। আমদানি-রপ্তানির সহজ সুবিধা ও বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে শিল্পকারখানা ছাড়াও মিরসরাই-সীতাকুণ্ড ঘেঁষে প্রকৃতির অপার দান বঙ্গোপসাগর উপকূলভাগের সুবিধা কাজে লাগিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে কনটেইনার বন্দর। এর ফলে শিল্পে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি ও কাঁচামাল আমদানি হবে সহজ। গড়ে উঠবে উপশহর ও বিশ্বমানের পর্যটন কেন্দ্র। শিল্পনগর থেকে বন্দরনগরীতে কর্ণফুলী বঙ্গবন্ধু টানেল হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত সুপার ডাইক কাম মেরিন ড্রাইভওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। তা ছাড়া শিল্পনগরের কাছেই দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার লাইফ লাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও রেলপথ। ভবিষ্যতে পাশেই নির্মিত হবে হাইস্পিড রেললাইন। মিশবে নোয়াখালী-চট্টগ্রাম বাইপাস মহাসড়কে। সব মিলিয়ে এ শিল্পনগর দেশের আধুনিক অর্থনৈতিক হাব বা প্রাণকেন্দ্রে রূপ নিচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সুবিধা পাওয়া সহজ হবে। বন্দরের সুবিধাও শিল্পনগরে পাওয়া সহজ হবে। শিল্প স্থাপনে বিনিয়োগকারীদের অবকাঠামো সুবিধা হিসেবে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, গ্যাস ও পানির সংযোগ, কেন্দ্রীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পানি শোধনাগার, আবাসন, হাসপাতাল, প্রশাসনিক ভবন নির্মাণসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা রয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১৯ দশমিক ৫ কিলোমিটার সামুদ্রিক বেড়িবাঁধ, ২৩০ কেভিএ গ্রিড স্টেশন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ১৮টি কালভার্ট, দুই লেনের ১০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ এবং ১৭ কিলোমিটার গ্যাস পাইপলাইন নির্মিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে ৪০ হাজার টন ক্ষমতার জাহাজ বার্থিং করার মতো সমুদ্রবন্দর। শিল্পাঞ্চলকে সেবা দেয়ার লক্ষ্যে মীরসরাই ও সীতাকুণ্ডের মাঝামাঝি এলাকায় নির্মিত হবে মাঝারি আকারের একটি বন্দর। এছাড়া ছোটখাটো একটি বিমানবন্দরও নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে, যেখানে সমুদ্রবন্দর, রেল ও সড়ক যোগাযোগ, বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেরিন ড্রাইভ, ট্যুরিজম পার্ক, হাসপাতাল, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় এবং আবাসিক অঞ্চলের মতো সামাজিক অবকাঠামো থাকবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর প্রকৃতি, শক্তি ব্যবস্থা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে মিলে দেশের প্রথম ‘সবুজ’ বা ইকো-শিল্পনগরী হতে চলেছে।

যেসব প্রতিষ্ঠান এ শিল্পনগরে এরই মধ্যে বিনিয়োগ করছে, তার মধ্যে রয়েছে জাপানের বিখ্যাত নিপ্পন স্টিল, সজিত করপোরেশন, ভারতের এশিয়ান পেইন্টস, যুক্তরাজ্যের বার্জার পেইন্টস, চায়না জিনদুন গ্রুপ এবং বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের শিল্পগ্রুপগুলো।

বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) অধীনে এই জোনে এক হাজার ১৫০ একর জায়গার ওপর গড়ে উঠছে ইপিজেড। চট্টগ্রাম ইপিজেডে মোট ভূমির পরিমাণ ৪৫৩ একর। মীরসরাইতে ভূমি পাওয়া যাচ্ছে প্রায় তিনগুণের কাছাকাছি। সারাদেশের আটটি ইপিজেডের ভূমির পরিমাণ মোট দুই হাজার ৪০০ একর। আর শুধু মীরসরাইতেই এক হাজার ১৫০ একর। এটি হবে বেপজার অধীনে সবচেয়ে বড় শিল্পজোন।

বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে উদ্যোক্তারা একক অথবা যৌথ উদ্যোগে গার্মেন্ট-নিটওয়্যার এবং তার সহায়ক শিল্প, কৃষিপণ্য ও কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ পণ্য, ইস্পাত ও লোহাজাত শিল্প, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত, সোলার পার্ক, রাসায়নিক দ্রব্য, বৈদ্যুতিক ও ইলেট্রনিকস সরঞ্জাম, হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং (অটো পার্টস ও সাইকেল), ওষুধ, ইন্টিগ্রেটেড টেক্সটাইল, কনটেইনার ম্যানুফ্যাকচারিং, শিপ বিল্ডিং, ভোজ্যতেল, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, খাদ্য ও পানীয়, কাগজ, প্লাস্টিক,  চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পেইন্টস, মোটরবাইক, মোটরযান বা অটোমোবাইল, আইটি, বিভিন্ন সেবা খাতে বিনিয়োগ এবং শিল্প ও কলকারখানা স্থাপন করছে।

বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের অবস্থান ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে হওয়ায় এবং সামুদ্রিক অর্থনৈতিক অঞ্চল হওয়ায় এটি বেজাকে বড় পরিসরে স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রাণিত করছে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এবং শিল্পায়নের ফলে গ্রামের মানুষের শহরাঞ্চলের দিকে আগমন এখন দেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। ফলে শহরাঞ্চলগুলোয় জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে। বর্তমানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৭ হাজার ৪০০ জন বসবাস করছে। পৃথিবীর সর্বাধিক ঘনবসতিপূর্ণ শহর হয়ে উঠেছে ঢাকা। শহরে জনসংখ্যা বাড়লে কর্মসংস্থান ও অন্যান্য সর্বজনীন পরিষেবার পাশাপাশি আবাসন, পরিবহন, জ্বালানি ও অন্যান্য অবকাঠামোগত ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে বাংলাদেশ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। নগরায়ণের সমস্যাগুলো মোকাবিলার জন্য একটি অত্যাধুনিক শিল্পনগর হতে পারে সঠিক সমাধান, যা অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে এবং উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এটি জীবনমান উন্নয়নের অন্যান্য উপায় ব্যবহার করে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত দিকগুলোর সঙ্গে মিলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজšে§র চাহিদা পূরণ করতে পারবে।

অত্যাধুনিক শিল্পনগরগুলোয় ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে শহরের অবকাঠামো পর্যবেক্ষণ, যেমন ট্র্যাফিক, পার্কিং, পানি এমনকি বায়ুদূষণ প্রভৃতি সবকিছু পর্যবেক্ষণ করা হবে। ভবিষ্যতে এই শহরটি নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা এবং চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলা পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে। শুধু অর্থনৈতিক অঞ্চলের চিন্তা না করে এই বিশাল প্রকল্প অঞ্চলটিতে এমন এক পদ্ধতি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে, যা বাংলাদেশের সমগ্র অর্থনীতিকে পরিবর্তন করবে।

দেশের প্রথম পরিকল্পিত এই শহর বিশ্বমানের ব্যবসা ও শিল্পকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করবে। আগামী ১৫ বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর দেড় মিলিয়ন মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে এবং এখান থেকে ২৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি হবে। দেশীয় ও রপ্তানি বাজারের জন্য উৎপাদন শুরু করতে শহরটি বিশ্বজুড়ে শীর্ষস্থানীয় সংস্থাগুলোকে আকৃষ্ট করতে শুরু করেছে।

 

সরকারের সাবেক সচিব

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান