একটি লোভের পাপ এবং রূপকথার রাজপুত্রের গল্প

এহসান কলিন্স: উপনিবেশবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী নেতা মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, আর্থ প্রভাইডস এনাফ টু স্যাটিসফাই এভরি ম্যান’স নিডস, বাট নট টু এভরি ম্যান’স গ্রিড। অর্থাৎ পৃথিবী প্রতিটি মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ দ্রব্য সরবরাহ করে, তবে প্রত্যেক মানুষের লোভ পরিপূরণ করতে পারে না।”

আমাদের দেশের কিছু মেয়ে এবং কিছু মেয়ের পরিবার কেন এত লোভী হয়? কথাটি বললাম কটাক্ষ করে নয়, অনেক দুঃখ থেকেই! কারণ লোভ থাকা ভালো, কিন্তু সীমা লঙ্ঘন করে নয়। সব কিছুতেই লোভ দেখাতে হয় না। এতে করে ক্ষতিই হয়। লোভ পরিপূরণ করার আকাক্সক্ষা যদি ঘুম কেড়ে নেয়, সুখ কেড়ে নেয়, জীবন শেষ করে দেয়, তাহলে সেই লোভ দিয়ে কী লাভ?

(গল্পগুলো সব নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।)

গল্প-১: আমার নিজের দেখা সাতটি বছরের পশ্চিমা দেশের ভেলকিবাজির কাহিনি বললে শেষ করতে পারব না। তাই ছোট্ট একটি ঘটনা বলি।

আমি তখন সবেমাত্র পশ্চিমাদের খোলামেলা স্বল্প পোশাকে আবৃত মানুষের শহরে দাঁড়িয়ে আছি। তখন ব্রিকলেন ও হোয়াইট চ্যাপল জায়গা দুটি ছাড়া লন্ডনে আর কিছুই চিনি না। পাশেই দাঁড়ানো আমার বয়সী আরেকজন। স্বভাবতই তখন বাংলাদেশি কাউকে দেখলেই কথা বলতে ইচ্ছা হতো। গল্পের শুরু থেকে শেষ শুধুই চাপাবাজি শুনতে হলো। সেটি কেমন তা একটু বলি কোমরের নিচে ঝুলে পড়েছে ছেঁড়া জিন্স প্যান্ট, ঠোঁটের নিচে একগুচ্ছ দাড়ি, দুহাতে অনেকগুলো ব্রেসলেট আর কানে হেডফোন। কথার মাঝে মাঝেই একটু ঝাঁকি দিয়ে বলছে, অল রাইট ব্রভ (ব্রভ হচ্ছে  ইৎড়- ইৎড়ঃযবৎ-এর সংক্ষিপ্ত রূপ)। আর আমি একটু মাথা ঝুলিয়ে বলছি, ইয়েস, রাইট। কথা বলে জানতে পারলাম, তিনি বাংলা হোটেলের পেশাদার ওয়েটার। বেশ পাউন্ড পান প্রতিদিন। চারজন ছেলে একটি রুম ভাড়া করে থাকেন। ডিগ্রি পাস করে তিন বছর লন্ডনে এসেছেন। পড়াশোনা আর হয়ে ওঠেনি, অথবা চেষ্টাও করেননি। কিন্তু দেশে জানে ইউনিভারসিটিতে পড়ছেন। সদ্য বিয়ে করেছেন। মেয়েটি নর্থসাউথে এমবিএ পড়ছেন। আমি বললাম, আপনি বউকে কোথায় রাখবেন এবং কী করাবেন? তিনি বললেন কুল ম্যানÑশেয়ার করে থাকব বন্ধুদের সঙ্গে, আর ব্রিকলেনে আমার জানা বাংলা হোটেল আছে না? মেয়ে ওয়েটারের চাহিদা আছে। আমি বললাম, কিন্তু তার একাডেমিক ফিউচার? তিনি আবারও ইংলিশে বললেন, কাম অন ম্যান, দিস ইজ লাইফ। হয়তোবা মেয়েটি জানেই না স্বামীর ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে রান্না করে খেতে হবে দিনের পর দিন, নর্থসাউথের সার্টিফিকেটটি লাগেজে রেখে বাংলা হোটেলের কিচেন ক্লিন করতে হবে কত দিন। শুধু মেয়ে ও মেয়ের বাবা-মা জানেন, জামাই-মেয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় সেটল্ড্। মাঝে মাঝেই সানডে ইভিনিংয়ে ফেসবুকে দেখবেন কত রকমের রঙিন পিকচার। ট্যাগ পড়বে দু-একশ বাংলাদেশি বন্ধুদের পেজে। ওয়ালমার্ট, বোডিশপ, এইচ অ্যান্ড এম, টেসকো, সেইন্সবেরি, টি মোবাইল, ওটু, বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি কিছু কসমেটিকস, স্মার্টফোন ইত্যাদি নিয়ে কোনো এক সময় দেশে আসবে। আর সবাই বাহবা দিয়ে বলবে, আমার মেয়ে-জামাই ইউরোপে থাকে, আমেরিকায় থাকে। আর ওই জামাইটি দেখবেন বলবে, এত গরমে কি থাকা যায়? ওহ্ বিডি’তে কী যে পল্যুশন। অথচ ঢাকা শহরের কোনো করপোরেট ছেলে যদি ওই মেয়েটিকেই বিয়ের প্রস্তাব দিত তাহলে হয়তোবা ছেলেটিকে একশ একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো, আর যদি আনফরচুনেটলি ছেলেটি মাপে একটু শর্ট হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই!

আসলে পৃথিবীর বড় ওয়েল রেপুটেড জায়গাগুলো জীবনের জন্য কিছুই নয়। এই জায়গাগুলো শুধুই আমাদের অবস্থানের বিড়ম্বনা মাত্র। এই জায়গাগুলো, এই স্ট্যাটাসগুলো, এই উচ্চশিক্ষাগুলো আমাদের জীবনের শেষ ডেস্টিনেশন নয়। আমরা যে যেখানেই আছি, খুব সামান্য জায়গা নিয়ে আছি। অতি ক্ষুদ্র কিছু নিয়ে আছি। আমাদের ভাবতে হবে, এর থেকে সহস্রকোটি বড় কিছু রয়ে গেছে এই পৃথিবীতে, যা আমাদের দেখার অনেক বাকি। একটি শুদ্ধ ট্রান্সপারেন্ট জীবন নিয়ে বেঁচে থাকাটাই হচ্ছে আমাদের প্রকৃত জীবন। বাবা-মা জীবনের সবচেয়ে বড় টিচার; কিন্তু বাবা-মা কখনোই জীবনকে ক্রিয়েট করে দিতে পারে না, জীবনের উৎসগুলো বলে দিতে পারে মাত্র।

গল্প-২: পৃথিবীর কয়েকটি বেঞ্চমার্ক কোম্পানির মধ্যে এমন একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে যখন চাকরি করি, সেসময় একদিন সাতসকালে অফিসে বসে কাজ করছি। শুনতে পাচ্ছিলাম একজন মানুষের উচ্চ স্বরে কান্না। কাজ ফেলে উইমেন্স সেকশনে গিয়ে দেখি, একজন কোর্ট-টাই পরিহিত ভদ্রলোক ফ্লোরে বসে আমার এক মেয়ে কলিগের পা জড়িয়ে ধরে রেখেছে এবং চিৎকার করছে আর বলছে, প্লিজ আমার ঘর ভেঙো না, তুমি ঘরে ফিরে চলো। আমি তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম কিছু সময়। তারপর ভদ্রলোকটি যাতে পা ছেড়ে দেয়, সে চেষ্টা করছিলাম। এই অফিস টাইমে লোকটি কীভাবে এই অফিসের উইমেন্স সেকশনে ঢুকে পড়ল, সেটা আমরা কেউই বুঝে উঠতে পারছিলাম না এবং তখন পর্যন্ত আমরা কেউ জানতেও পারছিলাম না কে এই ভদ্রলোক এবং কেনই-বা মেয়েটির পা জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন।

একপর্যায়ে সিকিউরিটি এলো এবং আমাকে দায়িত্ব দেয়া হলো লোকটির সঙ্গে কথা বলে প্রকৃত ঘটনাটি জানতে। আমি সত্যিই খুব অবাক হচ্ছিলাম ভদ্রলোকটির কথাটা শুনে। এই ভদ্রলোকটিই মেয়েটির স্বামী এবং তিনি ব্যাংকার। গেস্ট রুমে লোকটি কান্নাভেজা চোখে আমাকে যে বিবরণ দিচ্ছিলেন, তাতে সত্যি বিশ্বাস হচ্ছিল না একপক্ষের কথা শুনে। যদিও পরে মেয়েটির সঙ্গেই কথা বলি এবং অন্যের কাছ থেকেও অনেক সত্যতা জানতে পারি।

মেয়েটি কোনো এক মফস্বল শহর থেকে সদ্য পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় এসেছে। স্বামীর স্বল্প আয় এবং নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা সব মিলিয়ে ক্যারিয়ার সেন্ট্রিক চিন্তাটাই তার জন্য বড় বিষয় ছিল এবং এটা হওয়াটাই খুব স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু যে বর্তমানের জন্যেই আমাদের যুদ্ধে নামা, সেটাকে তো আর ইগনর করা যাবে না। প্রথম প্রথম যখন ঢাকাতে এসেছিল, তখন নিতান্তই সাদামাটা ছিল মেয়েটি। এত্তবড় একটা বহুজাতিক কোম্পানির  চাকরি পেয়েছে, সেটা তো কম বড় কথা নয়। কিন্তু সবকিছুর ঊর্ধ্বে হচ্ছে আমাদের মূল শিকড় নিয়ে বেঁচে থাকা, নিজের পরিবারের, সমাজ-সংসার নিয়ে বেঁচে থাকা। কিছুদিন পর জানতে পেরেছিলাম তাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল শেষ পর্যন্ত এবং দিব্যি জীবন চালিয়ে যাচ্ছিল কলিগ আর বসের সঙ্গেই। হয়তো মেয়েটি সাময়িক চাহিদা ও স্মার্ট জীবনের স্বাদ নিয়েছে, কিন্তু তাতে কি সত্যিকারের জীবনের স্বাদ পেয়েছিল? হয়তো না।

গল্প-৩: এবার আসি আমাদের একটি রূপকথার রাজপুত্রের গল্প নিয়ে। কিছুদিন আগেই ঘটে গেল একটি মেয়ের আত্মহত্যার করুণ গদ্য। যদিও আমার কাছে খুবই কমন গল্পই মনে হয়েছে, কারণ ছোটবেলা থেকেই আমরা সবাই কম-বেশি বাংলা সিনেমা দেখে এসেছি। আর ওইখানে সব সিনেমার একই দৃশ্য চোখে পড়েছে, তা হলো রাজা-রাজপুতদের নাচনেওয়ালি থাকত, যাকে বলে বাইজি। অথবা রক্ষিতা থাকত রাজা-রাজপুতের বিনোদনের জন্য। রাজা-রাজপুতেরা টাকার বাক্স নিয়ে রক্ষিতার ঘরে যেত, সারারাত আমোদ-ফুর্তি করত, আর বাইজি কিংবা রক্ষিতারা সারারাত নিজেদের শরীর বিলিয়ে দিয়ে তাদের খায়েশ মিটাত। এটা মোগল সুলতানের আমল থেকে হয়ে আসছে মধ্যবিশ্ব কিংবা এশিয়া সাব-কন্টিনেন্টাল অঞ্চলে। আর এটারই আধুনিক ভার্সন রয়ে আছে পশ্চিমা বিশ্বে, আর এই রক্ষিতা কিংবা বাইজিকেই তারা ব্যবহার করে এসকর্ট বলে। এই এসকর্টগুলোও আমাদের রাজা-রাজপুতের খায়েশ মেটানোর মতো এক শিহরিত শক্তি দেয় পশ্চিমা ধনির দুলালিদের।

আমার কাছে কিছুদিন আগের ধনীর দুলালি রক্ষিতার আত্মহননের গদ্যটি একই মনে হয়েছে। তবে মেয়েটির বয়স অনেক কম হওয়ায় মেয়েটি বুঝতেই পারেনি সে ছিল রক্ষিতা, অথবা মেয়েটির বাবা-মা না থাকায় পরিবারও সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

এই যে এসব রাজা-রাজপুতের ভোগবিলাসী জীবনের গল্প বলছি, তাদের আসলে কোনো আদালত থাকে না এবং তাদের পুঁজিবাদী অর্থের জোগানের কাছে আমাদের এসব সাজানো আদালত বৈশাখী ঝড়ে বৃক্ষ-দোলার মতো দুলতে থাকে। হয়তো একটা সময় অতিবাহিত হলে তা নুয়ে পড়ে। তাহলে আমাদের যে বোন, যে মেয়েটি বাইজি হয়, রক্ষিতা হয়, কেন তারা ভোগবিনোদিনী থেকে প্রেমিকা হওয়ার স্বপ্ন দেখবে? কেনই-বা বাইজি কিংবা রক্ষিতা মেয়েটির পরিবার জানবে না এই কাঠখোট্টা নির্মম শহরে লক্ষপতি হতে, লক্ষপতি ঘরে থাকতে কাঠখোট্টা পোড়াতে হয় অনেক। আর তা যদি সহজেই হয়ে যায়, ভেবে নিতে হবে সেটা হবে ভঙ্গুর, নশ্বর।

মনে রাখতে হবে, প্রতিটি নারী আমাদের ও আমাদের পরিবারের একটি সম্মানিত জায়গা, একটি আবেগের জায়গা। আর তা ভক্ষকের কবল থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব প্রথমে নিজেরই এবং স্বয়ং পরিবারেরই। ভালোবাসা যেন কখনও লোভ না হয়, আর তা থেকে পাপ না হয়। অনেক সত্য-মিথ্যার ভিড়ে আসুন আমরা সবাই সত্য হয়ে বাঁচি।

কথাসাহিত্যিক

ahasan.collins@gmail.com