প্রকৃত তথ্য গোপন বাংলাদেশ ব্যাংকের

এক দেশে রিজার্ভের তিন হিসাব নিয়ে ধোঁয়াশা!

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ কতÑতা নিয়ে অনেকেরই আগ্রহ রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা বা অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ছাড়াও সাধারণ মানুষ জানতে চায় দেশের প্রকৃত রিজার্ভ কত। বাংলাদেশ ব্যাংক মোট রিজার্ভ নিয়ে প্রতি সপ্তাহে দুটো তথ্য প্রকাশ করে। তবে রিজার্ভের প্রকৃত প্রকাশ করে না সংস্থাটি। তাই নিট রিজার্ভের তথ্য নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। সবার একটাই প্রশ্নÑবর্তমানে দেশের প্রকৃত রিজার্ভ ঠিক কত!

যদিও প্রকৃত বা নিট রিজার্ভের তথ্য শুধু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যে দুটো তথ্য প্রকাশ করা হয়, তা গ্রস (মোট) হিসাব। তবে প্রকৃত রিজার্ভের হিসাব আড়ালেই রাখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নিট রিজার্ভ সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল প্রায় সোয়া পাঁচ বিলিয়ন ডলার ছাড় দেয়ায় এ নিয়ে সম্প্রতি আরও ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে, যে বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ কত রয়েছে।

সূত্রমতে, আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেয়া নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ১১ কোটি (২০.১১ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার। এ লক্ষ্যমাত্রা আইএমএফ ১ হাজার ৪৭৬ (১৪.৭৬৯ বিলিয়ন) কোটি ডলারে নামিয়ে এনেছে। সে হিসাবে রিজার্ভ সংরক্ষণ লক্ষ্যমাত্রা কমেছে ৫৩৪ কোটি (৫.৩৪১ বিলিয়ন) ডলার। এতেই মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে, নিট রিজার্ভ কি তাহলে ১৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে অবস্থান করছে।

জানা যায়, আইএমএফ তার সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাব করার একটি নীতিমালা জারি করেছে, যা বিশ্বে বিপিএম-৬ নামে পরিচিত। বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদনের সময় শর্ত হিসেবে   আইএমএফের ব্যালান্স অব পেমেন্টস এবং ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম-৬) অনুযায়ী রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করার জন্য বলা হয়।

এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু গ্রস রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করত। যদিও রিজার্ভ প্রকাশের দুটি তথ্য পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। একটি হচ্ছে গ্রস, অন্যটি নিট হিসাব। আইএমএফের পদ্ধতিতে হিসাব করলে বৈদেশিক রিজার্ভ গণনায় চলতি বৈদেশিক দায় ও ঋণ এবং রিজার্ভের অর্থ অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করলে তা গ্রস থেকে বাদ যাবে। তবে এ পদ্ধতিতেও বাংলাদেশ ব্যাংক বিপিএম-৬ অনুযায়ী শুধু গ্রস হিসাব প্রকাশ করছে। নিট রিজার্ভের তথ্য গোপনেই রাখছে।

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ৮ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসেবে রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৫২৭ কোটি (২৫.২৭ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার। আইএমএফের বিপিএম-৬ অনুযায়ী গ্রস রিজার্ভ ছিল এক হাজার ৯৮২ কোটি (১৯.৮২ বিলিয়ন) ডলার।

সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশের ব্যবহারযোগ্য বা প্রকৃত রিজার্ভ ১৪ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের ঘরে রয়েছে। প্রকৃত রিজার্ভ হলো দায়হীন রিজার্ভ। আইএমএফের দেয়া হিসাবপদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী, রিজার্ভ থেকে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায়, ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং হিসাবে থাকা অর্থ ও স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস (এসডিআর) হিসেবে থাকা ডলার বাদ পড়বে নিট হিসাবে। এদিকে ঋণের শর্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পরপর প্রকৃত রিজার্ভ কী পরিমাণে থাকতে হবে, তা ঠিক করে দেয় আইএমএফ। তাই বাংলাদেশকে আইএমএফের শর্ত মেনে প্রতি তিন মাস পরপর রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে হয়। তবে ঋণ কর্মসূচি শুরুর পর থেকে রিজার্ভের ত্রৈমাসিক কোনো লক্ষ্যমাত্রাই পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ।

আইএমএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর মার্চে রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২২ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। আর জুনে ২৩ দশমিক ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে নিট রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার।

আইএমএফের নথি থেকে আরও জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বরে রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রার প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৬ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। তবে বাংলাদেশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তা কমিয়ে করা হয়েছিল ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। তবে সেটিও পূরণে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫৮ কোটি ডলার কম ছিল রিজার্ভ।

একই ধারাবাহিকতায় গত মার্চে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে করা হয় ১৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার। তখন রিজার্ভ ছিল ১৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। তবে জুনে রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। এটিও পূরণ করতে পারবে না বাংলাদেশ। ফলে বাংলাদেশ সফরে আসা প্রতিনিধিদলের কাছে রিজার্ভ সংরক্ষণের শর্তে ছাড় চাওয়া হয়। তা মেনেই সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে আইএমএফ।

প্রসঙ্গত, দেশের ইতিহাসে ২০২১ সালের আগস্টে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে। আর সে সময় বিপিএম-৬ অনুযায়ী গ্রস রিজার্ভ ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। এ রেকর্ড হয় সাবেক বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের আমলে। তবে সে রিজার্ভ ধরতে রাখতে পারেননি ফজলে কবির নিজেই। তার আমলে কমতে শুরু করা সে রিজার্ভে ধস নামে বর্তমান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার দায়িত্ব নেয়ার পর। তার দায়িত্ব নেয়ার মাত্র পৌনে দুই বছরের মাথায় ২৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসে গ্রস রিজার্ভ।