মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশন দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প

এক প্রকল্পেই পলকের পকেটে যেত ২৯ কোটি টাকা

হামিদুর রহমান: ডিজিটাল থেকে স্মার্ট স্বপ্ন বুনে বিগত ১৫ থেকে ১৭ বছর নানা রকম প্রকল্প থেকে বিপুল অর্থ লোট করা হয়েছে আইসিটি খাতে। মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশনের দক্ষতা উন্নয়ন (৩য় সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পেই ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৩৩০ কোটি টাকা। আর এতে অতিরিক্ত বরাদ্দ ছিল প্রায় ২৯ কোটি টাকা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে আইসিটি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পে আয়-ব্যয়সহ নানা অনিয়মের তদন্ত করছে। বেশ কিছু অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত অপচয়ের মহৎসব পেয়েছে তদন্ত কমিটি। মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশনের দক্ষতা উন্নয়ন (৩য় সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পেই ২৮ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দের তথ্য পেয়েছে তদন্ত কমিটি। তাদের অভিযোগ, এভাবে প্রকল্প বুঝে বিপুল অর্থ লোপাট করেছে জুনায়েদ আহমেদ পলক।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ৩৩০ কোটি টাকার মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশনের দক্ষতা উন্নয়ন (৩য় সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পের মধ্যে যেসব খাতে সাশ্রয় করা হয়েছে তা হলোÑ প্রশিক্ষণ ব্যয়ে সাশ্রয় করা হয়েছে ১ কোটি ৪০ লাখ ৮০ হাজার টাকা, সফটওয়্যার/কনটেন্ট ডেভেলপমেন্টে সাশ্রয় করা হয়েছে ২১ কোটি ৪১ লাখ ৮৪ হাজার টাকা, বেতন ভাতা বাবদ সাশ্রয় করা হয়েছে ৬২ লাখ ৪৭ হাজার টাকা, কম্পিউটার-আনুষঙ্গিক ও রেনোভেশনে সাশ্রয় করা হয়েছে ১৪ লাখ ১১ হাজার টাকা, অফিস সরঞ্জাম ও আসবাবপত্রে সাশ্রয় করা হয়েছে ২৫ লাখ ৭৯ হাজার টাকা, কনটিনজেন্সিতে সাশ্রয় করা হয়েছে ৪ কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাতে সাশ্রয় করা হয়েছে ৯৬ লাখ ৮৮ হাজার টাকা।
তদন্ত কমিটি জানিয়েছে, প্রায় প্রতিটি প্রকল্পে পাওয়া গেছে লুটপাটের চিত্র। কেনাকাটা হয়েছে আকাশচুম্বী দামে। আর এসব লোটপাট হয়েছে সাবেক তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের নেতৃত্বে। অনিয়মের শীর্ষে থাকায় প্রকল্পগুলোর মধ্যে ইডিসি প্রকল্প বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশসহ চলমান প্রকল্পগুলোর ব্যয় কামানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, তদন্তে টাকার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। প্রায় সব প্রকল্পে সরাসরি যোগাযোগ রাখতেন জুনায়েদ আহমেদ পলক। তার নির্দেশের বাইরে ওইসব প্রকল্পের কোনো টাকা ছাড় হতো না। প্রকল্প পরিচালকরা (পিডি) নিয়মিত হাজিরা দিতেন প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরে। সেখানে তিনি রুদ্ধদ্বার বৈঠক করতেন। বৈঠকের কোনো সিদ্ধান্ত বাইরে প্রকাশ করা মানা ছিল। তাই বিড়ালকে থলে ভরে মুড়ে রাখা হয়েছে এত দিন। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের ফলে বিশাল অঙ্কের প্রকল্পের দুর্নীতি নামক থলের বিড়াল বেরিয়ে আসছে।
জানতে চাইলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী শেয়ার বিজকে বলেন, “বিভিন্ন প্রকল্পে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য মিলেছে। নানাভাবে প্রকল্পগুলোয় অনিয়ম করা হয়েছে। এমনকি প্রয়োজন নেই, এমন প্রকল্পেও অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আবার ২ টাকা জিনিসের জন্য কয়েকগুণ বেশি অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। ৫ টাকার কাজে ২০ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। আমরা অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো ইতোমধ্যে কিছু বাদ করেছি। যেখানে অতিরিক্ত ব্যয় ধরা হয়েছিল সেগুলো বাদ দিয়েছি। আর অনেক তদন্ত চলছে পর্যায়ক্রমে আমরা সেগুলো নিয়ে মিডিয়ায় আলোচনা করব; মানুষকে জানানোর জন্য। একই সঙ্গে কীভাবে দেশ ও জনগণের সর্বোচ্চ লাভ হয়; তা দেখছি।’

ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। ওই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে দেশের প্রতিটি খাতকে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ও এর মাধ্যমে খাতগুলোর ডিজিটাল রূপান্তর নিশ্চিত করার কথা। এ সেøাগান সামনে রেখে ২০১০ সাল থেকে একের পর এক প্রকল্প নিয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ। এরপর ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এ সেøাগান পাল্টে ‘স্মার্ট বাংলাদেশের’ ধারণা সামনে আনেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সেøাগানের মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে দেশের সব সেবা ও মাধ্যম ডিজিটালে রূপান্তর, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এর আওতায় নেয়া হয় আরও নতুন নতুন প্রকল্প। মূলত উন্নয়নের গল্প বলে এসব প্রকল্প থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোট করা হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সব মিলিয়ে ২০১০ সাল থেকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত আইসিটি বিভাগের মাধ্যমে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। যদিও এসব উদ্যোগের বেশির ভাগই ফলপ্রসূ হয়নি। প্রকল্পগুলোয় মোট ব্যয়ের সিংহভাগই হয়েছে অবকাঠামো উন্নয়নে। কিন্তু এত বিপুল ব্যয়ের বিপরীতে উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করতে পারেনি প্রকল্পগুলো। আবার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ কর্মী গড়ে তুলতেও বেশকিছু প্রকল্প নেয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানেও প্রশিক্ষণার্থীদের পরে আইসিটি শিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়নি।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের পলিসি অ্যাডভাইজার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইসিটি নীতি উপদেষ্টা ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব শেয়ার বিজকে বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পর যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসেছে। তাদের মোটিভেশন সামনে রেখে আমরা প্রথমেই প্রকল্পগুলো তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছি। আমাদের উপদেষ্টার নির্দেশ যে প্রকল্পগুলোয় অনিয়ম এবং দুর্নীতি হয়েছে সেগুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া এবং একই সাথে সামনে যে প্রকল্পগুলো তা হতে হবে সাশ্রয়ী, দুর্নীতি মুক্ত এবং ট্রান্সপারেন্ট ও ভবিষ্যতমুখী। যাতে করে এই প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে দেশের মানুষ সত্যিকার অর্থে উপকৃত হয়।’

মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে আগের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা নিজেদের খেয়াল খুশিমতো কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। আর প্রকল্পগুলোর টেন্ডার থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত সব পর্যায়েই প্রভাব খাটাতেন পলকের ঘনিষ্ঠরা। তারা নিজেদের মতো করে বিভিন্ন প্রকল্প তৈরি করতেন। এসব প্রকল্পের কোনো ধরনের সম্ভাব্যতাও যাচাই করা হতো না।