নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম: একাধিক বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠান নিয়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করে বিভিন্ন গ্রুপ। এর মধ্যে এক বা দুটি প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়তে পারে। এ কারণে অনেক সময় অনিয়মিত হয়ে পড়তে পারে ঋণ পরিশোধের কিস্তি। তবে একটি প্রতিষ্ঠানের পাওনা পরিশোধের ব্যর্থতায় গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাধারণত অর্থপ্রবাহ বন্ধ করে দিয়ে খেলাপির দিকে ঠেলে দেয়া হয়। এতে বাণিজ্যিক গ্রুপগুলো ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়ে। ফলে বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ। এমন নিয়ম অন্যান্য দেশে নেই, যার পরিবর্তন চান ব্যবসায়ীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, বড় শিল্প গ্রুপগুলোর একাধিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থাকে। এর মধ্যে অনিয়ন্ত্রণযোগ্য কারণে একটি বা দুটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ব্যবসায় খারাপ করতেই পারে। এ কারণে ঋণখেলাপিও হতে হয়। কিন্তু গ্রুপের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান লাভে থাকে। আর এসব লাভজনক প্রতিষ্ঠানের আয় কিংবা মুনাফা থেকে লোকসানি প্রতিষ্ঠানের দায় পরিশোধ করার সক্ষমতা থাকে। অথচ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো একটি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের দায়ে গ্রুপের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়ে পুরো গ্রুপকে খেলাপি গ্রুপে পরিণত করে দেয়। এ কারণে দেশে বড় বড় শিল্পগ্রুপ স্বল্প সময়ে খেলাপি গ্রুপে রূপান্তর হয়। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে স্থাপিত ভোজ্যতেলের বড় বড় রিফাইনারি, পেপার মিল, স্টিল মিল, শিপব্রেকিং ইয়ার্ড, শিপ বিল্ডিং ইয়ার্ড, পোশাক কারখানা, ডাল মিল, কনডেন্স মিলসহ বিভিন্ন ধরনের হাজারেরও বেশি বাণিজ্যিক ও শিল্প-কারখানা অলস বসে আছে। অথচ এসব গ্রুপের ব্যবসা থাকলে দেশের অর্থনীতি আরও গতিশীল হতো। এমনকি জিডিপিতে আরও অবদান রাখতে পারত। এতে শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের জীবনমান আরও বৃদ্ধি পেত বলে মনে করছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা।
‘ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১’-এর ২৭কক (৩) ধারায় বলা হয়, খেলাপি ঋণের গ্রহীতার অনুকূলে কোনো ব্যাংক কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোনোরূপ ঋণ সুবিধা প্রদান করবে না। অপরদিকে বাংলাদেশে ব্যাংকের বিআরপিডির একটি সার্কুলারে বলা হয়, কোনো ব্যক্তি খেলাপি হলে, যদি অন্য কোম্পানি ২০ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করে, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানে ঋণ দেয়া যাবে না।
এ বিষয়ে মোস্তফা গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান শফিক উদ্দিন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমাদের ৬০ বছরের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা আছে। কিছু কারণে গ্রুপের দুই-একটি প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়েছিল। কিন্তু সব প্রতিষ্ঠান তো একসঙ্গে লোকসান করেনি। অথচ একটা-দুটা প্রতিষ্ঠানের লোকসানের কারণে ব্যাংকগুলো গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠানকে সহযোগিতা করা বন্ধ করে দেয়। এতে পুরো গ্রুপ ঋণখেলাপি হয়ে পড়ে। এ ধরনের আইনকানুন পৃথিবীর কোনো দেশে নেই। আমরা লাভজনক প্রতিষ্ঠানের মুনাফা দিয়ে লোকসানি প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় শোধ করতে পারতাম। এর মধ্যে আমরা বেশ কয়েকটি ব্যাংকে রি-শিডিউল করছি। আশা করছি ব্যাংক যদি এলসিতে সহযোগিতা করে আমরা আবারও ঘুরে দাঁড়াব। আমাদের সুযোগ দিলে দেশের ব্যাংক খাত আবারও ঘুরে দাঁড়াবে, যাতে পুরো অর্থনীতি গতিশীল হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, একটি গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হওয়ায় তার অন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া যাচ্ছে না। অথচ তার প্রতিষ্ঠানগুলোয় ঋণ অনুমোদন আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে একটি প্রতিষ্ঠানের পাওনা অনিয়মিত হওয়ায় গ্রুপটির ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া একটু কঠিন হয়ে পড়ছে নতুন করে ঋণ না পাওয়ায়। আসলে আইন ও নিয়ম-নীতি মানার বাধ্যবাধকতার কারণে কিছু করার সুযোগ নেই।’
ব্যাংকিং ও ট্রেড ফিন্যান্স বিশ্লেষক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, একটি গ্রুপের বহুমাত্রিক ব্যবসা থাকে। অর্থাৎ একাধিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থাকে। এর মধ্যে একটি বা দুটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান যে কোনো কারণে খারাপ বা লোকসান করতে পারে। এটা স্বাভাবিক। কারণ ব্যবসায় লাভ-লোকসান থাকে। কিন্তু একটি বা দুটি প্রতিষ্ঠানের লোকসান বা খেলাপির কারণে গ্রুপের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়াটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত। একজন উদ্যোক্তা দীর্ঘমেয়াদে একটি প্রতিষ্ঠানের লোকসান পরিশোধ করতে পারবে, কিন্তু একাধিক প্রতিষ্ঠানের দায় তো সারা জীবনে শোধ করতে পারবে না, যার প্রভাব ব্যাংক খাতসহ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে পড়েছে।
এ বিষয়ে এসএ গ্রুপের চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দীন আলম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘১০ বছর পর আমি আমার পাঁচটি কারখানায় গ্যাস সংযোগ পেয়েছি। কিন্তু এ ১০ বছর তো আমাদের অনেক কষ্ট করে ব্যবসা চালিয়ে যেতে হয়েছে। এ সময় ব্যাংকের সুদ তো লাফিয়ে লাফিয়ে তিনগুণ পর্যন্ত হয়েছে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জে দেশের সবচেয়ে বড় ভোজ্যতেল রিফাইনারি আমরা চালু করতে পারছি না চলতি মূলধনের অভাবে। এই কারখানার দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা তিন হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে নতুন করে গ্যাস সংযোগ পাওয়ায় পেপার মিলে পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন শুরু হয়েছে। একইভাবে আমার পেপার মিল, কনডেন্স মিল্ক, বেভারেজ, লবণ, আটা, ময়দা ও ঘি কারখানা আছে। সব মিলিয়ে আমাদের সুযোগ ও ইচ্ছা আছে আবার আগের মতো পুরোপুরিভাবে ব্যবসায় ফিরে আসার। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি করার সুযোগসহ নীতিগত সহযোগিতা করতে হবে। এতে ব্যাংকের মন্দা ঋণ কমবে। তা না হলে এসব কারখানায় উৎপাদন বন্ধ থাকবে। লক্ষাধিক শ্রমিক-কর্মচারী বেকার বসে থাকবে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়ে থাকবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট নীতিমালার আওতায় বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি গ্রাহকরা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ২০ হাজার ৭০৩টি আবেদন করেন। এর মধ্যে ঋণ পুনঃতফসিল-সংক্রান্ত আবেদন পড়েছিল ১১ হাজার ২৬৪টি। আর এককালীন এক্সিট-সংক্রান্ত আবেদনের সংখ্যা ৯ হাজার ৪৩৯। এসব আবেদনের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৩ হাজার ৩০৭টি আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ১৯ হাজার ৬০৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর মধ্যে সাত হাজার ৩২৮ গ্রাহক ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধায় ১৮ হাজার ২০২ কোটি ৮৮ লাখ টাকার ঋণ নিয়মিত করেছে। পাঁচ হাজার ৯৭৯ খেলাপি গ্রাহক এককালীন এক্সিট সুবিধার আওতায় এক হাজার ৪০১ কোটি ৯২ লাখ টাকা নিয়মিত করেছে। আর ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট-সংক্রান্ত বিশেষ সুবিধা দিয়ে ব্যাংকগুলোর আদায় করা ডাউন পেমেন্টের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৪৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।