এক বছর অনিয়মের ২৪৯২ চালান আটক

## ৩৬৪ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটন

## ২৪টি ফৌজদারি, ৪টি মানিলন্ডারিং মামলা দায়ের

## ৪৪টি সিএন্ডএফ লাইসেন্স সাময়িক স্থগিত, ৪টি বাতিল

## ৫২৯ কন্টেইনার এমবিএম আটক, ১৯৪ কন্টেইনার পণ্য ধ্বংস

রহমত রহমান: চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের ৯৫ শতাংশ পণ্য রপ্তানি ও ৮৫ শতাংশ পণ্য আমদানি হয়ে থাকে। আমদানি-রপ্তানি থেকে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস মোট রাজস্বের প্রায় ৬৫ শতাংশ রাজস্ব আহরণ করে থাকে। আমদানি-রপ্তানির আড়ালে রাজস্ব ফাঁকি বেড়েই চলেছে; বিশেষ করে মিথ্যা ঘোষণা, বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচার ও শুল্ককর জালিয়াতি। রাজস্ব ফাঁকিবাজদের ধরতে বসে নেই কাস্টমস। নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে সব অনিয়ম ও রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয় না। তবে প্রতিবছর অনিয়ম, রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটন ও আদায় বাড়ছে। বাড়ছে মামলার সংখ্যা। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরের সাফল্য নিয়ে সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যানকে প্রতিবেদন দিয়েছে কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদায়ী অর্থবছরে অনিয়মের অভিযোগে দুই হাজার ৪৯২টি চালান ও ৫২৯ কন্টেইনার এমবিএম আটক করা হয়েছে। রাজস্ব ও জরিমানা হিসেবে ৩৬৪ কোটি টাকা আদায়, ৬১ কোটি টাকার পণ্য আটক, ২৪টি ফৌজদারি, চারটি মানি লন্ডারিং মামলা, ৪৪টি সিঅ্যান্ডএফ লাইসেন্স সাময়িক বাতিল ও চারটি লাইসেন্স চূড়ান্তভাবে বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকায় তিন সহকারী কমিশনার, সাত রাজস্ব কর্মকর্তা ও ২৫ সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার সূচনা করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, হাউসের এআইআর শাখা গত অর্থবছর অনিয়মের অভিযোগে মোট এক হাজার ৪৪৮টি পণ্য চালান আটক করে, যার মধ্যে বেশিরভাগ চালান মিথ্যা ঘোষণা ও অতিরিক্ত ঘোষণা দিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে। এসব চালান থেকে ১০৫ কোটি চার লাখ টাকার অতিরিক্ত রাজস্ব ও ৩৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। একইসঙ্গে জেটি পরীক্ষণ কর্তৃক অনিয়মের দায়ে ৮৭২টি পণ্য চালান আটক, ৫১ কোটি ৬২ লাখ টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব ও ১৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদায়ী অর্থবছর বন্ডের অধীনে আমদানি করা বাণিজ্যিক পণ্যের মোট ১২৩টি চালান আটক করা হয়েছে, যার বিপরীতে ৫৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা রাজস্ব ও ১০ কোটি টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। আমদানি নিষিদ্ধ শূকরের হাড়-মাংস আর চর্বির গুঁড়া, যা মিট অ্যান্ড বোন মিল (এমবিএম) নামে পরিচিত, সেগুলো হাঁস-মুরগি ও মাছের খাবার হিসেবে আমদানি করা হয়। এমবিএম মানবস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এক বছরে আমদানি নিষিদ্ধ ৫২৯টি কন্টেইনারে ৪৫টি চালানে ৯ হাজার ৭৪১ মেট্রিক টন এমবিএম আটক করা হয়, যার মূল্য প্রায় ৪৫ কোটি টাকা। কাপড় ও সুতা ঘোষণায় বালি আমদানির চারটি পণ্য চালান আটক করা হয়েছে। ১১টি নিলাম করা হয়েছে, যা থেকে ৬৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি প্রতিরোধ, ঝুঁকিপূর্ণ পণ্য শনাক্তকরণ এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে খালাসের লক্ষ্যে নতুন দুটি কন্টেইনার স্ক্যানার স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে কন্টেইনার স্ক্যানারের সংখ্যা হচ্ছে সাতটি।

১২ সেপ্টেম্বর ২০২০, শনিবার দৈনিক শেয়ার বিজ পত্রিকার লিড নিউজ

প্রতিবেদনে বলা হয়, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের আওতাধীন। গত অর্থবছর এ বিমানবন্দর থেকে ৩৪ কেজি স্বর্ণবার আটক করা হয়, যার মূল্য ১৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা। সাতটি ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে। এছাড়া এক কোটি ১৩ লাখ টাকার মুদ্রা, এক কোটি ৯৫ লাখ ৫৪ হাজার ২০০ শলাকা সিগারেট, ৪২২ বোতল মদ ও ৫৪ কেজি সিসা আটক করে মামলা করা হয়েছে। যাত্রীসেবা নিশ্চিতে গ্রিন চ্যানেল কার্যকর করা হয়েছে। ব্যাগেজ রুলের বিধিবিধান লিফলেট আকারে যাত্রীদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১৯৪টি কন্টেইনারে চার হাজার ৮০৭ মেট্রিক টন পচা ও মেয়াদোত্তীর্ণ ফল এবং আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য (এমবিএম) ধ্বংস করা হয়েছে, যা কাস্টম হাউসের ইতিহাসে একক বৃহত্তম ধ্বংস কার্যক্রম। এছাড়া বিমানবন্দর ও এয়ারফ্রেইট ইউনিটে দীর্ঘদিন পড়ে থাকা মালামাল ইনভেন্ট্রি করে নিলাম ধ্বংসের জন্য নিলাম শাখায় পাঠানো হয়েছে। হাউসের পাঁচ বছরের অধিক পুরোনো নথি ধ্বংসের জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি এরই মধ্যে ধ্বংসযোগ্য নথির যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শেষ করেছে। শিগগিরই তা ধ্বংস করা হবে। শুল্ককর জালিয়াতি রোধে এয়ারফ্রেইট গেটে ও পাঁচটি অফডকে কম্পিউটার স্থাপন ও অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সংযোগ প্রদান এবং এক্সিট নোট ইস্যুর ব্যবস্থাসহ বিমানবন্দর ব্যাংক থেকে শুল্ককর প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে ফৌজদারি ও মান্ডি লন্ডারিং মামলার বিষয়ে বলা হয়, মিথ্যা ঘোষণা, অর্থপাচারসহ নানা অভিযোগে চারটি মানি লন্ডারিং ও ১৭টি ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছে। কিছু অনিয়ম তদন্তাধীন রয়েছে। অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকায় ৪৪টি সিঅ্যান্ডএফ লাইসেন্স সাময়িকভাবে ও তিনটি চূড়ান্তভাবে বাতিল করা হয়েছে। অনিয়মের সঙ্গে জড়িত তিন সহকারী কমিশনার, সাত রাজস্ব কর্মকর্তা ও ২৫ সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার সূচনা করা হয়েছে। একজন কম্পিউটার অপারেটর ও একজন গাড়িচালককে সাসপেন্ড করা হয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অ্যাসাইকুডা সিস্টেম যাচাই করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর অনিয়মের দায়ে আরোপিত ব্যক্তিগত ও বিমোচন জরিমানা বাবদ প্রায় ১৮ কোটি টাকা অনাদায়ী পাওয়া গেছে। এছাড়া ২০১৩ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অ্যাসাইকুডা সিস্টেম যাচাই করে রপ্তানি পণ্য চালানে চার্জ বাবদ প্রায় সাত কোটি টাকা অনাদায়ী পাওয়া গেছে, যা আদায়ের জন্য সংশ্লিষ্ট রপ্তানিকারক সমিতি ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের নোটিস দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালে উচ্চমান সহকারী পদে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষার কার্যক্রম শেষ করে ৩৪ জনকে উচ্চমান সহকারী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে ইনহাউস প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বিপুল পরিমাণ টেস্ট রিপোর্ট জালিয়াতি হয়। জালিয়াতি বন্ধে বর্তমানে রাসায়নিক পরীক্ষক কর্তৃক প্রস্তুতকৃত টেস্ট রিপোর্ট রাসায়নিক পরীক্ষাগারের স্ক্যানার মেশিনে স্ক্যান করে সকাল ১১টা, বেলা ২টা ও বিকাল ৫টায় হাউসের সিস্টেম অ্যানালিস্টের কাছে ই-মেইলের মাধ্যমে পাঠানো হয়। রিপোর্ট হাউসের ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়। ফলে শুল্কায়নের সময় রিপোর্ট মিলিয়ে দেখা হয়। আমদানি করা সব পণ্য চালান আইন ও বিধি মোতাবেক খালাস হয়েছে কি না, তা যাচাইয়ের জন্য একাধিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। এরই মধ্যে ২০১৭ সালের মেনিফেস্ট রিকন্সিলিয়েশনের কাজ শেষ হয়েছে। ২০১৮ ও ২০১৯ সালের যাচাই কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের হিসাব অনুযায়ী, করোনার মধ্যেও ৪১ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৮ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। কম আদায় হয়েছে ১৬ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা।