এক লাখ রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে ‘প্রস্তুত’ ভাসানচর

নিজস্ব প্রতিবেদক: কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে এক লাখের পুনর্বাসনের জন্য নোয়াখালীর ভাসানচরকে প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। গতকাল জাতীয় সংসদ ভবনে মোহাম্মদ সুবিদ আলী ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে কমিটির বৈঠকের পর এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

ওই বিজ্ঞপ্তিতে ‘ভাসানচরে আবাসন ও দ্বীপের নিরাপত্তায় নেওয়া প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে এবং এক লক্ষ বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকের পুনর্বাসনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে’ বলে উল্লেখ করে সংসদীয় কমিটি দ্রুত রোহিঙ্গাদের সেখানে পাঠানোর সুপারিশ করে।

জাতিগত নিপীড়নের মুখে মিয়ানমার থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গার পালিয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়ার পর দুবছর আগে নোয়াখালীর হাতিয়ার চরঈশ্বর ইউনিয়নের ভাসানচরে তাদের আবাসনের জন্য প্রকল্প নেওয়া হয়।

এদিকে প্রকল্পটির জন্য সরকারের তহবিল থেকে দুই হাজার ৩১২ কোটি ১৫ লাখ ৩১ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। এর মধ্যে দুই হাজার ২৬৫ কোটি ৯০ লাখ ৪৪ টাকা ব্যয় হয়েছে। বাকি ৪৬ কোটি ২৪ লাখ ৩১ হাজার টাকা ‘জরুরি তহবিল’ হিসেবে রাখা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে নৌবাহিনী ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকের কার্যপত্রের তথ্যমতে, ‘প্রকল্পের ক্লাস্টার হাউজগুলোর ৯৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ১২০টি শেল্টার স্টেশনের মধ্যে সব শেল্টারের স্টিল ইরেকশন শেষ হয়েছে। এ পর্যন্ত ৯২টি শেল্টার স্টেশনের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টিতে দুটি হাসপাতাল, চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদফতরের (এইচএডি) অর্থায়নে গত ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে এর কাজ শুরু করা হয়েছে। চলতি বছরের নভেম্বর নাগাদ এর কাজ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া কয়েকটি শেল্টার পরিবর্তন করে দুটি স্কুল, তিনটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য, একটি ইউএন প্রতিনিধিদের জন্য, একটি বাংলাদেশের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) প্রতিনিধিদের ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়া সেখানে একটি সুপারশপও হচ্ছে।’

কার্যপত্রে আরও বলা হয়েছে, ‘দ্বীপটির নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য ৯ ফুট উচ্চতার ১২ কিলোমিটার বাঁধের কাজ শেষ হয়েছে। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ থেকে নিরাপত্তার জন্য দুই দশমিক এক কিলোমিটার স্ক্রিন ওয়াটারের মাধ্যমে শোর প্রটেকশনের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। দ্বীপটিতে বসবাসরতদের চলাচলের সুবিধার্থে আনুমানিক ৪০ কিলোমিটার ছোট-বড় অভ্যন্তরীণ রাস্তার কাজ ৯৯ শতাংশ শেষ হয়েছে।’

দ্বীপটিতে বসবাসরত জনবলের নিরাপত্তা জরুরি স্থানান্তরের জন্য চারটি ল্যান্ডিং ক্রাফট ইউটিলিটি (এলসিইউ) খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড কর্তৃক নির্মাণ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি এলসিইউ’র গ্রহণযোগ্যতা শেষ হয়েছে এবং অপরটি আগামী নভেম্বরে শেষ হবে বলে আশা করা যায়। এছাড়া এরই মধ্যে দুটি এলসিইউ ভাসানচরে মোতায়েনের জন্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাঠানো হয়েছে। চারটি হাইস্পিড বোট নির্মাণ শেষে বর্তমানে চট্টগ্রামে অবস্থান করছে। এ-ছাড়া দ্বীপটিতে পণ্যদ্রব্য ও জনবল চলাচলের সুবিধার জন্য প্রয়োজনীয় পন্টুন নির্মাণ এবং বোট ল্যান্ডিং সাইট তৈরির কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। জনগণের জরুরি উদ্ধার ও ত্রাণ কাজসহ পণ্য বহনের জন্য দুটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হেলিপ্যাড নির্মাণ করা হয়েছে।

এছাড়া দ্বীপটিতে ত্রাণসামগ্রী (খাদ্য ও অন্যান্য) সংরক্ষণে এক লাখ রোহিঙ্গার আনুমানিক তিন মাসের খাবার রাখার জন্য চারটি ওয়্যারহাউজ নির্মাণকাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। আর দ্বীপটির নিরাপত্তার জন্য বাসভবনের মধ্যে সিকিউরিটি হাউজের কাজ শতভাগ, সিকিউরিটি হাউস-২-এর কাজ ৯৯ ভাগ ও সিকিউরিটি হাউস-৩-এর কাজ ৮৬ শতাংশ শেষ হয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের জন্য ভাসানচরে একটি গ্রামীণফোন ও একটি রবি মোবাইল বেজ ট্রান্সসিভার স্টেশন-বিটিএস স্থাপন করা হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকাধীন টেলিটক নেটওয়ার্ক স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে বলেও কার্যপত্রে উল্লেখ করা হয়।

সে সঙ্গে এক মেগাওয়াট হাইব্রিড সোলার প্যানেল, প্রয়োজনীয় পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন লাইন ও দুটি ৫০০ কিলোওয়াটসম্পন্ন ডিজেল জেনারেটর স্থাপনের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে, যা পরীক্ষামূলক টেস্ট ও ট্রায়াল করা হয়েছে।

বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ সুবিদ আলী ভূঁইয়া গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বৈঠকে ভাসানচর আবাসন প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করা হয়। নৌবাহিনী ওই প্রকল্পের ওপর একটি মাল্টিমিডিয়া প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করে।’

বৈঠকে সংসদীয় কমিটির সদস্য মো. নাসির উদ্দিন, মো. মহিবুর রহমান ও নাহিদ ইজাহার খান, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আখতার হোসেন ভূঁইয়া, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সদর দফতরের লে. জেনারেল মো. সফিকুর রহমান, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংসদ সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

উল্লেখ্য, হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াও পেছনে ফেলে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় সাত লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে ২০১১ সালেও দলে দলে রোহিঙ্গা তাদের দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে আসে। কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরে থাকা ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক ডেটা রয়েছে সরকারের কাছে। কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের আবাসনের জন্য বিস্তীর্ণ পাহাড় ও বনভূমি কাটতে হয়েছে।