এখন তিনি উদ্যোক্তা

শূন্য হাতদুটিতে এখন পূর্ণতার হাতছানি। দূর হয়েছে অনিশ্চয়তা, পেরিয়ে গেছে নানা বাধা। জীবনযুদ্ধে আজও হার না মেনে এগিয়ে চলেছেন নাটোরের চলনবিল এলাকার গৃহবধূ ফাতেমা বানু। নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে। লেখাপড়া করান পাঁচ সন্তানকে। স্বামীকে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য শক্তি জুগিয়েছেন। এই সাফল্যগাথায় ফাতেমার সহায়ক শক্তি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের (পিডিবিএফ) ঋণ ও প্রশিক্ষণ।

নাটোরের সিংড়া উপজেলার কলম ইউনিয়নের জগৎপুরে ফাতেমার সংসার। গুড়নই নদীর পাশে ৭৩ শতাংশ জমির এক কোণে বসতবাড়িতে কোনো জৌলুস না থাকলেও গরু, ছাগল ও মুরগি পালনের শেডসহ নার্সারির অবস্থান আর্থিক সচ্ছলতার জানান দিচ্ছে। নতুন করে শুরু করেছেন মাছ চাষ।

ফাতেমা জানান, সাড়ে সাত বিঘা পুকুর ইজারা নিয়ে বিনিয়োগ করেছি ১৫ লাখ টাকা। পুকুরকে ঘিরে রুপালি স্বপ্নের জাল বুনছেন ফাতেমা। বড় পরিসরে গাভী পালনের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান কাজে লাগাতে চাই।

আগামী বছর ২০১৮ সালে পাকা দালানবাড়ি তৈরি করার ইচ্ছা আছে তার। তার স্বামী হাতেম আলী আগে রিকশা চালাতেন। এখন আর রিকশা চালান না। তিনি খামারে উৎপাদিত মুরগি বিক্রি করেন বাজারে; কখনও মাছ চাষ, কখনও গবাদিপশু পালনে সহযোগিতা করেন। ২০১৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কলম ইউনিয়ন পরিষদে মেম্বার নির্বাচিত হয়েছেন হাতেম আলী। তিনি বলেন, ফাতেমা সংসার পরিচালনার পুরো দায়িত্ব নেওয়ায় আমি জনপ্রতিনিধি হয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করছি। ফাতেমার এই রকমারি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সহায়ক শক্তি তার তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। সবাই কোনো না কোনোভাবে তাকে সাহায্য করে।

কক্সবাজার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে কম্পিউটারে ডিপ্লোমা অধ্যয়নরত মেজ ছেলে ফরহাদ পুকুরে কাজের ফাঁকে জানান, ছুটিতে এসে মায়ের কাজে সাহায্য করি। বড় ছেলে ফরহাদ রাজশাহী কলেজ থেকে অ্যাকাউন্টিংয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করে চাকরির চেষ্টা করছেন। বড় মেয়ে হীরা কলম কলেজে এইচএসসি পড়ছেন। ছোট মেয়ে মিরা কলম হাইস্কুলের এসএসসির ছাত্রী। সবার ছোট জসিম কেজি ওয়ানে পড়ে।

ফাতেমা বলেন, সংসারের চাকা ঠিকমতো ঘুরলে পরিশ্রম সার্থক হবে। পরিশ্রমী ও অধ্যবসায়ী ছেলেমেয়েরা মানুষের মতো মানুষ হবে। বিয়ের পর প্রায় ৩৬ বছর আগে শূন্য হাতে সংসারের হাল ধরলেও আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর সহযোগিতায় বিছিন্নভাবে

গরু-ছাগল ও মুরগি পালনের কাজ করেছি। ২০১৩ সালে পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের সঙ্গে পরিচিতির সূত্রে ১৫ সদস্যের সমিতি গঠন করে সভানেত্রী নির্বাচিত হই। ঋণ পাই দশ হাজার টাকা। একসঙ্গে সেই প্রথম এত টাকা ও প্রশিক্ষণ পাই। এরপর আর থেমে থাকিনি, সবকিছু পরিকল্পনামাফিক করেছি। ক্রমে ঋণের পরিধি বেড়ে এখন এক লাখ ৬০ হাজার টাকায় দাঁড়ায়। পাঁচ বছর ধরে সমিতিতে সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করছি। পিডিবিএফ শুধু ঋণ সুবিধাই দেয়নি, পেশাগত দক্ষতার প্রশিক্ষণ প্রদানের ফলে আমরা কর্মক্ষেত্রে সফল হয়েছি। সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে সন্তানদের পড়ালেখার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছি।

পিডিবিএফের সিংড়া সিনিয়র উপজেলা দারিদ্র্য বিমোচন কর্মকর্তা মো. নিহারুল আলম জানান, ফাতেমার কার্যক্রমে সন্তুষ্ট হয়ে পিডিবিএফ ক্ষুদ্রঋণকে বর্ধিত করে তাকে উদ্যোক্তা শ্রেণিভুক্ত করেছে। পিডিবিএফ নাটোরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. আবদুল মালেক বলেন, ফাতেমার মতো সারা জেলার গ্রামীণ জনপদে অসংখ্য সফল মানুষ তৈরিতে নিরলসভাবে কাজ করছি আমরা। পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন (পিডিবিএফ) স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচন, আত্মকর্মস্থান সৃষ্টি, আয়বর্ধনমূলক কর্মকাণ্ড ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে কাজ করছে। ঋণ সহায়তা ও পুঁজি গঠন ছাড়াও নারী উন্নয়ন এবং সুফলভোগী সদস্যদের দক্ষতা উন্নয়ন ও আয় বৃদ্ধিমূলক এবং সামাজিক উন্নয়ন ও সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে।

পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন (পিডিবিএফ) সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. মো. মনারুল ইসলাম বলেন, ২০১৮ সালের মধ্যে দেশের ২০টি জেলার ১০০ উপজেলার দুই লাখ পাঁচ হাজার ২৫২টি গ্রামীণ পরিবারের প্রায় ১০ লাখ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচন, আত্মকর্মস্থান সৃষ্টি, আয়বর্ধনমূলক কর্মকাণ্ড ও আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে কাজ করছে পিডিবিএফ। দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের লক্ষ্যে ফাতেমার মতো সারা দেশে উদ্যোক্তা তৈরিতে কাজ করছি আমরা।

 

তাপস কুমার, নাটোর