এত উদ্যোগের পরও এফডিআই কমছে কেন?

মাসুম বিল্লাহ: কোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সাধারণত যেসব দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা ভালো, সেখানে এফডিআইয়ের জন্য অনুকূল পরিবেশ থাকে বলে ধরে নেওয়া হয়। এর পাশাপাশি বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বিনিয়োগ আকর্ষণে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে অগ্রাধিকার দেওয়ার পাশাপাশি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরই মধ্যে চালু হয়েছে কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল। পর্যায়ক্রমে এমন ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হবে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু বিনিয়োগ বাড়ছে না। অর্থনৈতিক অঞ্চলে ফাঁকা পড়ে থাকছে প্লট। বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীদের জন্য পৃথক অর্থনৈতিক অঞ্চলের ব্যবস্থা করেও বিনিয়োগ আকর্ষণ করা যাচ্ছে না। এসব উদ্যোগের ফলে স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, বিনিয়োগ বাড়বে। কিন্তু এর ঠিক উল্টো চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে।
জাতিসংঘ বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলনের (আঙ্কটাড) ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০১৮ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে কমেছে বিদেশি বিনিয়োগ। প্রতিবেশী অনেক দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়লেও এ সময়ে বাংলাদেশে কমেছে এর পরিমাণ। অথচ বাংলাদেশ থেকে অন্য দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে দুই দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৬ সালে এর পরিমাণ ছিল দুই দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত বছর দেশে বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ কমেছে প্রায় সাত দশমিক ৭৮ শতাংশ। গত বছর দেশে এফডিআই আসা কমলেও বিনিয়োগ দেশের বাইরে যাওয়া বেড়েছে অনেক বেশি। এ সময় দেশ থেকে ১৭ কোটি ডলার বিদেশে বিনিয়োগ হয়েছে। ২০১৬ সালে এর পরিমাণ ছিল মাত্র চার কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরে বিদেশি বাংলাদেশের বিনিয়োগ বেড়েছে ১৩ কোটি ডলার বা ৩১৯ শতাংশ।
অন্যদিকে সামাজিক নানা সূচকে পিছিয়ে থাকা প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে ২০১৭ সালে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে বিদেশি বিনিয়োগ। দেশটিতে এখনও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায়নি। আর গত বছরের আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতনকে কেন্দ্র করে মানবাধিকার প্রশ্নে দেশটির প্রতি রুষ্ট হয়েছে বিশ্ব বিবেক। এতকিছুর পরও দেশটিতে বাড়ছে বিদেশি বিনিয়োগ। গত বছর দেশটিতে এফডিআই প্রবাহের পরিমাণ ছিল চার দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার। এক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে মিয়ানমারের অবস্থান সবচেয়ে ওপরে। অথচ ২০১৬ সালে দেশটির তুলনায় বাংলাদেশে এফডিআই বেশি ছিল। ওই বছরে মিয়ানমারে এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল দুই দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে গত বছর এফডিআই আকর্ষণে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে ছিল ইথিওপিয়া ও কম্বোডিয়া। দেশ দুটিতে এ সময় এফডিআই প্রবাহ ছিল যথাক্রমে তিন দশমিক ৫৯ ও দুই দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। পাকিস্তানেও আগের বছরের তুলনায় গত বছর বেড়েছে এফডিআই। ২০১৬ সালে দেশটিতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ছিল আড়াই বিলিয়ন ডলার। গত বছর তা বেড়ে হয়েছে দুই দশমিক আট বিলিয়ন ডলার।
এরই মধ্যে গত ৭ জুন জাতীয় সংসদে বিনিয়োগ আকর্ষণে বেশকিছু উদ্যোগের কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এর মধ্যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কথা বেশ জোর দিয়েই বলেছেন তিনি। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘‘দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত বর্ধিত বিনিয়োগ। আমরা সরকারি খাতে বিনিয়োগ ক্রমান্বয়ে বাড়াচ্ছি। তবে এ বিনিয়োগের মূল উদ্দেশ্য হলো বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির সংযোগ প্রাপ্তি, বিনিয়োগ প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ, নিষ্কণ্টক জমির প্রাপ্যতা প্রভৃতি নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। এসব সেবা সহজলভ্য করে বৃহৎ ও রফতানিমুখী শিল্পের বিকাশ ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোয় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা ২০১০ সালে ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন’ প্রণয়ন করি। এর আওতায় ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়া ‘বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল নীতি ২০১৫’ জারি করা হয়। বর্তমানে বেজায় ওয়ান স্টপ সার্ভিসের আওতায় বিনিয়োগকারীদের প্রজেক্ট ক্লিয়ারেন্স, ভিসা রিকমেন্ডেশন ও অ্যাসিস্ট্যান্স, ওয়ার্ক পারমিট, ইমপোর্ট/এক্সপোর্ট পারমিট অনলাইনে প্রদান করা হচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে মোট ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা।” অর্থমন্ত্রীর ভাষ্যমতে, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে এ পর্যন্ত মোট ৭৬টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ১০টি অঞ্চলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছে। এসব অঞ্চলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শিল্প স্থাপনের কাজ শুরু করেছেন। আরও ২৬টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়নকাজ চলমান। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর কাজ শেষ হলে অতিরিক্ত ৪০ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় বাড়বে এবং প্রায় এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। কিন্তু এসব বিষয় এখনও কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। এসবের বাস্তব রূপ কবে নাগাদ দেখা যাবে তা এখনও বোঝা দায়।
বিনিয়োগের অন্যতম পূর্বশর্ত বিদ্যুৎ-জ্বালানিসহ যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন। এক্ষেত্রে সরকার অনেক উদ্যোগ নিয়েছে বলে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন।
অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ৯ বছরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ২৭টি থেকে ১১৮টিতে উন্নীত হয়েছে; বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা তিনগুণ বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৩৫৩ মেগাওয়াটে। সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড ২০০৯ সালের তিন হাজার ২৬৮ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ১০ হাজার ৯৫৮ মেগাওয়াটে দাঁড়িয়েছে। বিগত ৯ বছরে দুই হাজার ৬২২ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন এবং এক লাখ ৭৪ হাজার কিলোমিটার বিতরণ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে মোট সঞ্চালন ও মোট বিতরণ লাইনের দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ১০ হাজার ৬৮০ সার্কিট কিলোমিটার এবং চার লাখ ৫০ হাজার কিলোমিটার। এ সময়ে বিদ্যুতের সিস্টেম লস ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে ১১ দশমিক শূন্য শতাংশে নেমে এসেছে। সার্বিকভাবে বিদ্যুৎ সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীর হার ৪৭ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।’
জ্বালানির বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা নতুন গ্যাস ও তেলক্ষেত্র অনুসন্ধানের ওপর জোর দিয়েছি। আমাদের প্রচেষ্টায় জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ২০০৯ সালের আট দশমিক ৯ লাখ মেট্রিক টন থেকে বর্তমানে ১২ দশমিক ২১ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। সদ্য আবিষ্কৃত ভোলা গ্যাসক্ষেত্রসহ মোট প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্রের সংখ্যা বর্তমানে ২৭টি। এর মধ্যে ২০টি থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ক্ষমতা ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসের এক হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে দুই হাজার ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত হয়েছে।’
যোগাযোগ খাতের বিষয়ে বলা হয়েছে, সড়ক, রেল ও নৌপথের সমন্বিত উন্নয়ন, যানজট নিরসন ও নিরাপদ পরিবহন নিশ্চিত করা হচ্ছে। বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত সময়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়ক, ঢাকা-ময়মনসিংহ জাতীয় মহাসড়ক, নবীনগর ডিইপিজেড-চন্দ্রা মহাসড়ক, যাত্রাবাড়ী-কাঁচপুর মহাসড়কসহ মোট ৪৬৫ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ককে চার বা তদূর্ধ্ব লেনে উন্নীত করা হয়েছে, তিন হাজার ৯৩১ কিলোমিটার মহাসড়ক মজবুতকরণ ও চার হাজার ৫৯২ কিলোমিটার মহাসড়ককে প্রশস্ত করা হয়েছে; ৮৪২টি সেতু ও তিন হাজার ৫৪৬টি কালভার্ট নির্মাণ/পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। ২০০৯ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২৯৮ কিলোমিটার নতুন রেলপথ, ২৭৬টি রেলসেতু ও ৮২টি স্টেশন বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়েছে; ২৪৯ কিলোমিটার রেলপথকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর ও ৬২টি বন্ধ রেলস্টেশন চালু করা হয়েছে। এ সময়ে ১১৬টি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে ও ৩৬টি ট্রেনের সেবা সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
এত উদ্যোগের পরও বিদেশি বিনিয়োগ কেন বাড়ছে না? উত্তরটি অবশ্য দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির তথ্যমতে, যেসব দেশে বিনিয়োগ পরিবেশ খুবই নাজুক, বাংলাদেশ সেগুলোর অন্যতম। বিশ্বব্যাংকের ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ সূচকে ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৭তম। অর্থাৎ বিনিয়োগ পরিবেশে বাংলাদেশের অবস্থান একদম তলানিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে।
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা রয়েছে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে। তবে এ খাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক বেশি। আর অবকাঠামোগত দুর্বলতায় প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় এক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। এজন্য আশানুরূপ বিনিয়োগ এ খাতে আসছে না। অথচ মিয়ানমার দ্রুত অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে বড় আকারের এফডিআই নিয়ে যাচ্ছে। অনেকগুলো নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হলেও সক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রাপ্তি এখনও নিশ্চিত হয়নি। ক্রমেই কমে আসছে প্রাকৃতিক গ্যাসের দেশীয় রিজার্ভ। ঘাটতি পূরণে এলএনজি আমদানি করা হলেও তা অপ্রতুল। অবকাঠামো উন্নয়নে মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও বাস্তবায়নের গতি খুবই শ্লথ। ব্যাংক, আর্থিক খাত ও পুঁজিবাজারের দুরবস্থা কাটাতে কোনো সংস্কারের উদ্যোগ সদ্য ঘোষিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় নেই। এসব পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির গতি বাড়ার কোনো কারণ নেই।

সাংবাদিক