সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম : ঈদের আগে টানা দুই সপ্তাহ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্তির অধ্যাদেশ বাতিলসহ চার দফা দাবিতে পূর্ণাঙ্গ কলম বিরতিতে বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তখন স্থবির হয়ে পড়েছে শুল্কায়ন কার্যক্রম। এখন আবার এনবিআর চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে কলম বিরতিতে স্থবিরতা বিরাজ করছে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ও শুল্কায়নে। এতে বন্দরে কনটেইনারজটসহ ব্যবসায়ী পণ্য ছাড় করে আর্থিক ব্যয় ও ভোগান্তি বাড়ছে।
জানা যায়, দেশের আমদানি-রপ্তানির ৯২ ভাগ হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এর প্রায় পুরোটা শুল্কায়ন হয় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে। কিন্তু এনবিআর ভেঙে আলাদা দুটি বিভাগ চালুর প্রতিবাদে গত সপ্তাহব্যাপী কলম বিরতিতে কাস্টমস হাউসের কর্মকর্তারা। চলতি সপ্তাহে নতুন বদলি আদেশ বাতিল, এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশ বাতিল, এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণসহ দাবিতে এনবিআরের অধীন সব ভ্যাট, কাস্টমস ও কর অফিসে কলম বিরতি চলছে। সঙ্গে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আর দাবি আদায় না হলে আগামী সপ্তাহে থেকে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের পুরোপুরি শাটডাউন কর্মসূচি পালন করবে। এমন অবস্থায় কাস্টমস হাইজে স্থবির হয়ে পড়েছে রাজস্ব কার্যক্রম। গত মঙ্গলবার রাজধানীর আঁগারগাওয়ে রাজস্ব ভবনে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ডাকা সংবাদ সম্মেলন করে এ প্রতীকী প্রতিবাদ করেন তারা। একই সঙ্গে সবশেষ বদলি আদেশ অনুযায়ী পাঁচ কর্মকর্মতার এ দিন নতুন দপ্তরে যোগদানের নির্দেশনা থাকলেও সেখানে তারা যোগ দেননি।
চেয়ারম্যানকে ‘আওয়ামী লীগ সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী’ আমলা আখ্যা দিয়ে এবং তার বিরুদ্ধে ‘দেশ ও রাজস্ব ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টায় লিপ্ত’ থাকার অভিযোগ তুলে পরিষদ সোমবার নতুন কর্মসূচি ডেকেছে।
এনবিআর চেয়ারম্যানকে আগামী শুক্রবারের মধ্যে অপসারণ না করা হলে শনিবার থেকে কর, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সব দপ্তরে ‘লাগাতার কমপ্লিট শাটডাউন’ চলবে ঘোষণাও করা হয় পরিষদের তরফে। তবে আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা এই ‘কমপ্লিট শাটডাউনের’ আওতা বহির্ভূত থাকবে।
রাজস্ব সংস্কারে সেমিনার করতে গেলে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদকে কক্ষ বরাদ্দ না দেয়া, আগের আন্দোলনে জড়িতদের বদলি আদেশ জারি, এনবিআর ভাগ করে দুটি বিভাগের যে অধ্যাদেশ জারি হয়েছিল তা বাস্তবায়নে গঠিত সমন্বয় কমিটির মধ্যে পরিষদের প্রতিনিধিত্ব না রাখায় চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবি জোরালো হয়েছে।
বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীরা বলেন, এনবিআর কর্তাদের আন্দোলনে আমদানি ও রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে শুল্কায়ন কার্যক্রম। এর প্রভাব পড়েছে পণ্য খালাসেও। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্য খালাস নিতে না পারায় আমদানিকারকদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ।
অপরদিকে বন্দরের পরিবহন শাখার এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গতকাল সকালে বন্দর ইয়ার্ডে মোট কনটেইনার জমা ছিল ৩৭ হাজার ৩৮৩ টিইইউএস কনটেইনার। একই দিনে বন্দর থেকে কনটেইনার ডেলিভারি হয়েছে চার হাজার ৫৩৯ একক।
আমদানিকারকরা বলছেন, খাদ্যপণ্য ও শিল্পপণ্য সময়মতো খালাস না হওয়ায় বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থায় প্রভাব পড়ছে। এছাড়া রাজস্ব ও বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমারও শঙ্কা করা হচ্ছে। এ দিকে শুল্ক কর্মকর্তাদের পুরোপুরি কলম বিরতিতে ব্যাহত হচ্ছে খালাস কার্যক্রম। এতে আবারও চট্টগ্রাম বন্দরে তৈরি হবে পণ্যজট। গত মঙ্গলবার দুপুরে বেলায় কিছুটা কাজ হলেও গতকাল দুপুরে পুরোপুরি বন্ধ। পাশাপাশি শুল্কায়নে দীর্ঘসূত্রতায় পণ্যের ওপর মাসুলও বাড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে রাজস্ব আদায়ে বিরূপ প্রভাবে শঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, ‘কেউ কোনো কাজ করতে পারছে না। ওখানে গিয়ে দেখা যায় পণ্যের শুল্কায়ন কাজ বন্ধ রয়েছে। পোর্টে যে ডেমারেজ আসছে এক্সপোর্ট ও ইমপোর্টের, এই টাকা সিএনএফও দেবে না কাষ্টমসও দেবে না। এটা দেবে এক্সপোর্টার এবং ইমপোর্টার। তাহলে লাভটা কার হচ্ছে। সবাই তো ক্ষতি হচ্ছে। ’
চট্টগ্রাম সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি জামাল উদ্দিন বাবলু বলেন, ‘বন্দরের ডেমারেজ চার্জ এখন ৪ গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রতিটি পণ্যের ওপর এই ডেমারেজ চার্জ কনভার্ট করে, যে আমদানি করে সে পণ্যের দাম নির্ধারণ করে। অতএব পণ্যের মূল্য বাড়বে। আমদানি খরচও বাড়বে। তাই তাড়াতাড়ি এ সংকটের সমাধান হওয়া উচিত। ’
বন্দরের কর্মকর্তারা বলেন, আন্দোলনের প্রভাব তেমন পড়েনি। তবে আগামীতে পড়বে। এখন আগের কনটেইনার ডেলিভারি হচ্ছে। তবে আন্দোলনে শুল্কায়ন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এতে পণ্য খালাস কম হবে। এ কারণে বন্দরে কনটেইনার ও জাহাজ জট তৈরি হতে পারে।
অপরদিকে এনবিআরের সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি হাসাম মোহাম্মদ তারেক সাংবাদিকদের বলেন, সরকার ২৫ মে এর অবস্থান থেকে সরে এসেছে। এখন বিপরীত কথা বলছে। এছাড়া আজকের মিটিংয়ে আমাদের প্রতিনিধি রাখা হয়নি। তাই আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব। এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ এনবিআর ও এনবিআরের অধীন সব ভ্যাট, কাস্টমস ও কর অফিসে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি চলছে। সঙ্গে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আর দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। আমরা মনে করি চেয়ারম্যানের পদত্যাগের সত্যিকারের সংস্কার কার্যক্রমের সূচনা হবে।