পলাশ শরিফ: বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) পরিচালন মুনাফা নেই। বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি ও বেতন-ভাতা বাড়ায় লোকসানের মুখে পড়েছে সংস্থাটি। এরপরও বিশাল অঙ্কের এফডিআরের সুদে মুনাফা ধরে রেখেছে ডেসকো।
তবে ব্যাংকে আমানতের সুদের হার কমার কারণে সর্বশেষ অর্থবছরে কর-পরবর্তী মুনাফা কমেছে ১১৯ কোটি টাকা। আয়-ব্যয়ে ভারসাম্যহীনতার পাশাপাশি কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনে গরমিলও চোখে পড়েছে। এছাড়া ডেসকোর ২৭৯ কোটি টাকার সম্পদের নথিপত্রও খুঁজে পায়নি নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান।
আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ে ডেসকোর পরিচালন আয় দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ১২৬ কোটি চার লাখ টাকা, যা এর আগে অর্থবছরে দুই হাজার ৭৯৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ছিল। এক বছরে কোম্পানিটির আয় প্রায় ৩২৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা বেড়েছে। তবে আয় বাড়লেও এক বছরেই পরিচালন লোকসানের মুখে পড়েছে ডেসকো। আগের অর্থবছরে ৯৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা পরিচালন মুনাফা করা কোম্পানিটি সর্বশেষ অর্থবছরে পাঁচ কোটি ৯২ লাখ টাকা পরিচালন লোকসানে পড়েছে। এর নেপথ্যের উল্লেখযোগ্য কারণ ব্যবস্থাপনা ব্যয় বৃদ্ধি ও ক্রয়মূল্যের তুলনায় ৫ শতাংশ কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রি।
তবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এফডিআর ও স্বল্পমেয়াদি আমানতের (এসটিডি) সুদ বাবদ আয় হয় ৯৬ কোটি ২১ লাখ টাকা। এর ওপর ভিত্তি করেই মুনাফা করে ডেসকো। যদিও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কোম্পানিটির সুদ বাবদ আয় ছিল ১২৩ কোটি আট লাখ টাকা।
ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. শাহিদ সারওয়ার এনডিসি, পিএসসি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘মূলত বিদ্যুৎ কিনে তা গ্রাহকের কাছে বিক্রি করাই ডেসকোর মূল কাজ। ২০১৫ সালের পর থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে প্রায় ৫ শতাংশ কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। যে কারণে পরিচালন লোকসানের মুখে পড়তে হয়েছে। অন্যদিকে ব্যাংকের আমানতের সুদের হার উল্লেখযোগ্য হারে কমার কারণে আয় কমেছে। এসব কারণেই কর-পরবর্তী মুনাফা কমেছে।’
উল্লেখ্য, ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে বিভিন্ন ব্যাংকে ৯৯০ কোটি পাঁচ লাখ টাকার বেশি এফডিআর ছিল ডেসকোর। পাশাপাশি ১৫০ কোটি ৫০ লাখ টাকার এসটিডিও ছিল কোম্পানিটির।
বিদ্যুতের চাহিদার ৮ শতাংশের জোগানদাতা কোম্পানিটির পরিচালন ব্যয় আগের বছরের তুলনায় এক দশমিক ৭৮ শতাংশ কমলেও সর্বশেষ অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি আয় ৭৩ শতাংশ কমেছে। এর বিপরীতে সরকারি নির্দেশনার কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রায় ৭৫ শতাংশ বেড়েছে। আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, গত এক বছরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ ব্যবস্থাপনা ব্যয় ৩৪ কোটি ৮২ লাখ টাকা বেড়েছে। অন্যদিকে বিক্রয়মূল্যের তুলনায় পাঁচ শতাংশ কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রিও লোকসানের অন্যতম কারণ।
তবে আয়-ব্যয়ে ভারসাম্যহীনতার মধ্যেও ব্যাংকের স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) মুনাফাসহ অ-পরিচালন আয়ের ওপর ভর করে সর্বশেষ অর্থবছরে ৪৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে ডেসকো। এ সময়ে ৬৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা অ-পরিচালন মুনাফা করেছে কোম্পানিটি।
২০০৬ সালে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির কর-পরবর্তী মুনাফা পাঁচ বছরের ব্যবধানে ৩৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা কমেছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে ৮৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করেছিল, যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সর্বশেষ ৪৪ কোটি ৬১ লাখ টাকায় নেমেছে। একই সঙ্গে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) দুই টাকা ১০ পয়সা ও শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) তিন টাকা ৫১ পয়সা কমেছে। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেও কর-পরবর্তী মুনাফা কমার প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী মুনাফা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চার কোটি ৯ লাখ টাকা কমে ২২ কোটি ৬৩ লাখ টাকায় নেমেছে। আর কর-পরবর্তী মুনাফার নেতিবাচক প্রবণতায় ২০১৫ সালের ১৯ জানুয়ারি থেকে গতকাল (সোমবার) পর্যন্ত ডিএসইতে কোম্পানিটির শেয়ারদর ১৩ টাকা ১০ পয়সা কমেছে।
এদিকে কোম্পানিটির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত বিদ্যুৎ কেনাবেচা ও ২০১৫ সালের গ্রস প্রফিটের তথ্যে গরমিল চোখে পড়েছে। ওই প্রতিবেদনের (৯ পৃষ্ঠায়) শুরুতে ডেসকোর পাঁচ বছরের আয়-ব্যয়ের দ্বিতীয় অংশে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দুই হাজার ৮৯৫ কোটি ৬৬ লাখ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ বিক্রির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে একই অর্থবছরে চার হাজার ৪১০ কোটি ২০ লাখ টাকার বিদ্যুৎ কেনার কথাও বলা হয়েছে। ওই অংশে বিদ্যুৎ বিক্রির স্থলে বিদ্যুৎ কেনা আর কেনার স্থলে বিক্রির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এদিকে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ডেসকোর মোট মুনাফা দেখানো হয় ২৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। বাস্তবে এটি হবে ২৫৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
অন্যদিকে কোম্পানিটির নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান আর্টিসান চার্টার্ড অ্যাক্যাউনট্যান্সের প্রতিবেদনে ‘পূর্বসূরি ডেসার কাছ থেকে পাওয়া ২৭৯ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদের সপক্ষে ডেসকো কোনো চুক্তিপত্র দেখাতে পারেনি’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।