মো. সুলাইমান: রপ্তানিমুখী সব পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতিটি এলসি নগদায়নের সময় রপ্তানি মূল্যের নির্ধারিত হারে অর্থ জমা দেয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে। এসব অর্থ শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় হওয়ার কথা। দেশের দুর্বল তিনটি ব্যাংক ও খুঁড়িয়ে চলা একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের ৬৫ কোটি টাকা এফডিআর হিসাবে জমা রেখেছিল। জমা রাখা এফডিআরের এসব অর্থ লুটেরাদের পকেটে চলে যাওয়ায় এখন আর টাকা ফেরত পাচ্ছে না মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত সরকারের আমলে বেশ কয়েকটি ব্যাংকে লুটপাট চালানো হয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো। আর এসব ব্যাংকের অধিকাংশই মাত্র একটি পরিবারের দখলে ছিল। তারা আমানতকারীদের টাকা ফেরত এবং এফডিআরের টাকাও ঠিকমত ফেরত দিতে পারছিল না। এসব দুর্বল ব্যাংককে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক তারল্য সহায়তা দিয়েছে। তারপরেও প্রতিষ্ঠানগুলোর সংকট পুরোপুরি কাটেনি। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ইউনিয়ন ব্যাংকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এফডিয়ার করা ২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকটির নওয়াবপুর রোড শাখায় ১০ কোটি টাকা এবং যমুনা ফিউচার পার্ক শাখায় ৫ কোটি টাকা। ইউনিয়ন ব্যাংকের এই দুই শাখার এফডিয়ারের মেয়াদপূর্তি হয়েছে ২০২৩ সালের আগস্ট ও নভেম্বরে। মন্ত্রণালয় বার বার চেষ্টা করেও টাকা ফেরত পায়নি।
এছাড়া গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের মহাখালী শাখায় ২০ কোটি টাকার এফডিআর করা হয়। যার মেয়াদপূর্তি হয়েছে ২০২৪ সালের এপ্রিল ও আগস্টে। এ ব্যাংকটি থেকেও টাকা ফেরত পাচ্ছে না মন্ত্রণালয়। অপরদিকে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের কারওয়ান বাজারের হেড অফিসে এফডিআর করা হয় ২০ কোটি টাকার। ২০২১ সালে যার মেয়াদপূর্তি হয়েছে। এতদিন পেরিয়ে গেলেও টাকা ফেরত দেয়নি ব্যাংকটি।
এফডিআরের মূল ও মুনাফার অর্থ ফেরত পেতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বেশ কয়েকবার তাগাদা দিয়েছেন কেন্দ্রীয় তহবিলের মহাপরিচালক। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকেও একাধিকবার চিঠি দেয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এরপরেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রমিকদের টাকা ফেরত দেয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান শেয়ার বিজকে বলেন, দুর্বল ব্যাংকে হয়তো বেশি লাভের আশায় এফডিআর করা হয়েছিল। যেহেতু কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আমানত রাখতে ব্যাংক ঠিক করে দেয় না, সেহেতু টাকা ফেরত না পেলেও তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে না। তবে মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংকে যে চিঠি পাঠিয়েছে, সেটি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে পাঠিয়ে তাগাদা দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সূত্র জানিয়েছে, এফডিআরের অর্থ ফেরত পেতে ২০২২ সালের আগস্টে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক এবং ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডকে চিঠি দেয়। এরপরও প্রতিষ্ঠান দুটি থেকে কোনো টাকা ফেরত না পেয়ে পুনরায় ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে চিঠি পাঠায়। এছাড়া মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠান দুটি সরাসরি গিয়েও অর্থ ফেরত পাওয়ার বিষয়ে কোনো সুরহা করা সম্ভব হয়নি।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান শেয়ার বিজকে বলেন, এফডিআরের টাকা ফেরত পেতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে ঘুরছি। তবে কোনোভাবে টাকা ফেরত পাচ্ছি না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকেও চিঠি দেয়া হয়েছে। যেসব ব্যাংকে এফডিআর করা হয়েছে সেসব ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা একাবারে দুর্বল হয়ে পড়েছে। মন্ত্রণালয়ে আগে যারা দায়িত্বে ছিলেন তারাই এসব দুর্বল প্রতিষ্ঠানে টাকা রেখেছিল।
ব্যাংকগুলোর মধ্যে অনিয়ম-দুর্নীতিতে তীব্র তারল্য সংকটে থাকা গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করা হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যাংক দুটিতে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক দুটির মধ্যে গত সেপ্টেম্বর শেষে ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১২ হাজার ২১৭ কোটি টাকা; যা মোট ঋণের ৪৩ দশমিক ৯২ শতাংশ। অথচ ব্যাংকটি তীব্র অর্থ সংকটে রয়েছে। ইতোমধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংকে অডিট শুরু হওয়ায় বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে ব্যাংকটির প্রকৃত খেলাপির চিত্র। গত সেপ্টেম্বর শেষে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা। ব্যাংকটির মোট বিতরণ করা ঋণের ২৬ দশমিক ৯২ শতাংশই খেলাপি। অথচ এ ব্যাংকটিও তীব্র তারল্য সংকটে রয়েছে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই-একদিনের মধ্যে ডিসেম্বর প্রান্তিকের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ পাবে। এই প্রান্তিকে দুর্বল ব্যাংকগুলোর খেলাপি আরও বাড়বে।
লুটপাটে কাবু আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক এবার আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। ভেঙে পড়েছে ঋণ-আমানত শৃঙ্খলাও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে আইসিবির খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬৬৫ কোটি টাকা। ব্যাংকটির মোট বিতরণ করা ঋণের ৮৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে।