অর্থবছর ২০২২-২৩

এবারও উপেক্ষিত শিশু বাজেট

মাসুম বিল্লাহ: ২০১৩ সালের শিশু আইন অনুযায়ী, শূন্য থেকে ১৮ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর শিশু হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশ এই বয়সভিত্তিক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। সংখ্যায় তারা সাত কোটির বেশি। তাদের জন্য বাজেটের ২০ শতাংশ ব্যয় করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে সরকারের। ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত শিশুদের জন্য বরাদ্দ ছিল বাজেটের ১৫ শতাংশের মতো। বিষয়টি বাজেটের পৃথক একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু পরপর তিনটি অর্থবছরে শিশু বাজেট বিষয়ে কোনো প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে না। এমনকি গত বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট ঘোষণা করেছেন, সেখানে শিশু বাজেটের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। ফলে দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধাররা উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছেন বাজেটে।

জানা যায়, সরকারের ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ শিশুকেন্দ্রিক নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে। এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে রয়েছেÑপ্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, জননিরাপত্তা বিভাগ, তথ্য মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং আইন ও বিচার বিভাগ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সম্মিলিত বাজেট বরাদ্দ ছিল এক লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেবল শিশুকেন্দ্রিক বাজেট ছিল ৮০ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এই বরাদ্দ ব্যয়িত হলে কোনো না কোনোভাবে শিশুরা উপকৃত হবে।

এটি ওই অর্থবছরের মোট বাজেটের প্রায় ১৫ শতাংশ। ধীরে ধীরে শিশুকেন্দ্রিক এ বরাদ্দ বাজেটের ২০ শতাংশে উন্নীত করার বিষয়ে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু গত তিন অর্থবছরে শিশুকেন্দ্রিক বরাদ্দের পরিমাণ কতÑসে বিষয়ে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় না। ফলে জনগোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ ও বড় একটি অংশ উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে গত শুক্রবার রাজধানীর একটি হোটেলে বাজেট-পরবর্তী পর্যালোচনা তুলে ধরতে গিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে শিশু বাজেট প্রতিবেদন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। অথচ সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল যে, ২০২০ সালের মধ্যে তারা বাজেটের অন্তত ২০ শতাংশ বরাদ্দ নিশ্চিত করবে শিশুদের কল্যাণার্থে। কিন্তু বর্তমানে শিশুকেন্দ্রিক কী পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই।’

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে (ইউএনসিআরসি) উল্লিখিত শিশুদের অধিকার বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে এ সনদে স্বাক্ষর করে। এ সনদের লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার ২০১৩ সালে শিশু আইন প্রণয়ন করে। এ ছাড়া ২০১১ সালে জাতীয় শিশুনীতি গ্রহণ করে সরকার। সেই আলোকে বাজেটে শিশুদের জন্য বরাদ্দের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রতিবেদন প্রণয়ন করে আসছিল সরকার। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে শিশু বাজেট প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘বিকশিত শিশু: সমৃদ্ধ বাংলাদেশ’। কিন্তু এরপর থেকে শিশু বাজেট বিষয়ে আর কোনো প্রতিবেদন করা হয়নি। আগামী অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটে জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদন তুলে ধরা হলেও শিশু বাজেট প্রতিবেদন তৈরি করা হয়নি।

সরকারের তরফ থেকেই স্বীকার করা হয়েছে, দেশের ভবিষ্যৎ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির অন্যতম উত্তম পন্থা হলো শিশুদের ওপর কাক্সিক্ষত মাত্রায় সরকারি বিনিয়োগ নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে জাতীয় বাজেটে শিশুর হিস্য দক্ষতা, স্বচ্ছতা, সমতা ও জবাবদিহিতার মধ্য দিয়ে ব্যয় হচ্ছে কিনা, তাও সার্বক্ষণিক পরিবীক্ষণ করা প্রয়োজন বলেও সরকার মনে করে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে নিয়মিতভাবে প্রতি বছর জাতীয় সংসদ ও জনগণের অবগতির জন্য শিশু বাজেট প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে বলে ২০১৯-২০ অর্থবছরের শিশু বাজেট প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ কভিড শুরুর পর থেকে গত তিন অর্থবছরে সরকার শিশু বাজেট প্রতিবেদন প্রকাশ করছে না।

শিশু বাজেট প্রতিবেদন প্রণয়ন না করার কারণ জানতে অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদারের ব্যক্তিগত সেলফোন নম্বরে গতকাল একাধিকার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করা হলে তারা বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত না থাকায় তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫ ও ১৭ অনুচ্ছেদ, ইউএনসিআরসির ২৪, ২৮ ও ৩২ অনুচ্ছেদসহ শিশুনীতির বিভিন্ন অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সরকার শিশুদের জন্য খাদ্য, পুষ্টি, নিরাপদ পানি সরবরাহ, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাসহ অন্যান্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শিশুরা যেহেতু নিজেদের প্রয়োজন বিষয়ে বাজেট প্রণয়নে ভ‚মিকা রাখতে পারে না, তাই সরকার স্বপ্রণোদিত হয়ে বিভিন্ন নীতিমালা ও নির্দেশনার আলোকে তাদের প্রয়োজনগুলো মেটানোর লক্ষ্যে বাজেট বরাদ্দ দিয়ে থাকে। এছাড়া শিশুদের বাজেট বাস্তবায়নের সঙ্গে যেসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ যুক্ত তাদের নিজ নিজ কর্মপরিধিভুক্ত কার্যক্রমের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও অর্থায়নের উৎস চিহ্নিত করার নির্দেশনা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো শিশুদের জন্য কী ধরনের কার্যক্রম সম্পাদন করছে, তা উঠে আসে শিশুবাজেট প্রতিবেদনে। কিন্তু গত তিন অর্থবছর এ বিষয়ে কোনো প্রতিবেদন প্রণয়ন না করায় জনগোষ্ঠীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ শিশুদের জন্য সরকার কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, সে বিষয়ে কোনো ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না।