এমটিবির ছোট ঋণে বড় অনিয়ম

নিয়াজ মাহমুদ : মসলা প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রকল্পে বাস্তব অভিজ্ঞতাহীন প্রতিষ্ঠানকে বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণ দিয়েছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড (এমটিবি)। চার বছর আগে প্রদত্ত ওই ঋণ খেলাপি হয়ে পড়লেও সেটাকে ‘খেলাপি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি। বরং নামসর্বস্ব প্রকল্পটি পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন সুবিধাও পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন মহাব্যবস্থাপকের ঐকান্তিক অনুরোধে এমটিবির ঠাকুরগাঁও শাখা ওই ঋণটি অনুমোদন দিয়েছিল বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এমটিবির ঠাকুরগাঁও শাখায় ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘মেসার্স এসআরএস স্পাইসেস লিমিটেড’-এর (ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুম্পা রায়) নামে একটি চলতি হিসাব খোলা হয়। এদিকে হিসাব খোলার আগেই (৬ জানুয়ারি, ২০১৩) হলুদ ও মরিচের গুঁড়া উৎপাদনের (প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেট) লক্ষ্যে পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়ার সিপাইপাড়ায় একটি প্রকল্প স্থাপনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন সুবিধাসম্বলিত ছয় কোটি ৫৮ লাখ টাকা ঋণের জন্য এমটিবির শাখায় আবেদন করা হয়। শাখা কর্তৃক ঋণের প্রস্তাব একই বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি এমটিবির প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়। অর্থাৎ ব্যাংকের গ্রাহক হওয়ার আগেই গ্রাহকের আবেদন শাখা কর্তৃক তা মঞ্জুরির প্রস্তাব ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়।

জানা যায়, ঋণসুবিধাটির মার্কেটিং কর্মকর্তা এমটিবির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইকবাল। ২০১৩ সালের ২৩ জুন এসআরএস স্পাইসেসের বিল্ডিং নির্মাণ এবং প্রকল্পের মেশিনারিজ ও ইক্যুইপমেন্ট প্রক্রিয়াকরণের জন্য পাঁচ কোটি টাকার কৃষিজাত মেয়াদি মঞ্জুর করে এমটিবি। আর এক কোটি টাকা চলতি মূলধন হিসেবে মঞ্জুর করে। এসআরএস স্পাইসেসের নামে সর্বমোট ছয় কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রাম বিভাগ থেকে চার ধাপে পুনঃঅর্থায়ন করা হয়।

ঋণ মঞ্জুরির শাখার প্রস্তাব ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর উপস্থাপিত মেমো পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন সংক্রান্ত নথিতে ব্যাংকের এসএমই-সিআরএম বিভাগের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক (সুকমল সিনহা চৌধুরী) প্রতিষ্ঠানটিকে লোন দিতে ফোনে সুপারিশ করেছেন।

এদিকে ঋণ প্রস্তাবনায় গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুম্পা রায়ের অভিজ্ঞতা ১০ বছর ও প্রকল্পে ৯৩ শ্রমিক নিয়োজিত থাকার কথা উল্লেখ করা হলেও এমটিবির কর্মকর্তারা পরিদর্শন দলকে দেখাতে সক্ষম হয়নি। ৯৩ জন লোকবলের স্থলে তিনজন কর্মচারী নিয়োজিত বলে পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, একজন অব্যবসায়ীকে হলুদ ও মরিচের গুঁড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের লক্ষ্যে নতুন প্রকল্প স্থাপনের উদ্দেশ্যে শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপকের ঐকান্তিক অনুরোধের প্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ অপেশাদারিত্বের সঙ্গে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ঋণটি অনুমোদন করেছে এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

গতকাল এমটিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী আনিস এ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, বড় ব্যাংক, ছোটখাটো এ ধরনের মিসটেক হতেই পারে। তবে আমরা সব সময়ই সতর্কতার সঙ্গে ঋণ দিই। এর মধ্যেও অনেক সময় গ্রাহক চিনতে বা বুঝতে না পারার কারণে এমনটি হয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

তবে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা তিনি বলতে রাজি হননি। বিশিষ্ট এ ব্যাংকার অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান।

মেসার্স এসআরএস স্পাইসেস লিমিটেডের বর্তমান অবস্থা সরেজমিনে যাচাইয়ের লক্ষ্যে পরিদর্শন দল ব্যাংকটির শাখা ব্যবস্থাপকসহ প্রকল্প ঠিকানায় উপস্থিত হলে দেখা যায়, প্রকল্প স্থানে একটি টিনশেড বিল্ডিং আর দু-তিনটি একেবারে নি¤œমানের হলুদ ও মরিচ ভাঙানোর মেশিনারিজ রয়েছে। ওই স্থানে মেসার্স এসআরএ স্পাইসেস নামীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলমান নেই। বর্তমানে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বও সেখানে পাওয়া যায়নি।

এদিকে এমটিবি কৃষিজাত (টার্ম লোন) হিসাব বিবরণীতে পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৫ সালের ২৮ মে ঋণের তৃতীয় কিস্তি পরিশোধের পর ২০১৬ সালের ৩০ জুন ২.৯২টি ত্রৈমাসিক কিস্তির পরিমাণ আট মাসেরও বেশি অপরিশোধিত থাকা সত্ত্বেও শাখা কর্তৃক ঋণটি অশ্রেণীকৃত হিসেবে দেখানো হয়েছে। ব্যাংকিং মাপকাঠিতে ‘সন্দেহজনক মান’ এবং প্রতিষ্ঠানটি অস্তিত্ববিহীন ও বন্ধ থাকায় গুণগত ভিত্তিতে ‘মন্দমান’-এ শ্রেণীকরণ যোগ্য হলেও শাখা কর্তৃক ঋণটি অশ্রেণীকৃত হিসেবে দেখানো হয়েছে। এর মাধ্যমে গ্রাহককে অবৈধভাবে সুবিধা প্রদান করা হয়েছে।

পরিদর্শন টিমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বিষয়ে শাখা ব্যবস্থাপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও ঋণটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের পরিবর্তে কৃষিঋণ হিসেবে বিবেচনা করে সিএল-৫এ রিপোর্ট করা হচ্ছে মর্মে শাখা কর্তৃক পরিদর্শন দলকে অবহিত করা হয়। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন সার্কুলারের মাধ্যমে হলুদ ও মরিচের গুঁড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রদত্ত ঋণকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ঋণ হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে।