Print Date & Time : 16 September 2025 Tuesday 1:03 pm

এলএসডি ভয়াবহতম মাদকের প্রতিরূপ

খালিদ ফেরদৌস: এলএসডি বা লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইইথ্যালামাইড মাদকের ইতিহাস বেশ পুরোনো হলেও নতুনভাবে এটা ভয়ংকর বিভীষিকা হিসেবে ধরা দিয়েছে।

সম্প্রতি এলএসডিসহ পাঁচ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এটা পুলিশের রুটিন কাজ। কিন্তু গ্রেপ্তার পাঁচ শিক্ষার্থীর অভিব্যক্তি দেখে সচেতন মহল অবাক না হয়ে হতবাক হয়েছে। তাদের পুলিশ গ্রেপ্তার করে জেলে নিয়ে যাচ্ছে, জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। কিন্তু তাদের চোখে-মুখে কোনো চিন্তার ছাপ নেই। কী বীভৎস নির্ভার প্রাণোচ্ছল তারা! এর মূলে রয়েছে এলএসডির মতো ক্ষণিক আনন্দদায়ক মারণ নেশা। এটা দুরারোগ্য ব্যাধির চেয়ে মারাত্মক। এভাবে হাস্যোজ্জ্বল বদনে হাসতে হাসতে অনেক তরুণ নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দিয়ে দিচ্ছে, যা দেশ ও জাতির জন্য অশনি সংকেত। কিন্তু কী এক অদৃশ্য কারণে যারা বৈশ্বিক মাদক নিয়ন্ত্রণে জড়িত, তারা বিশ্বকে শুভঙ্করের ফাঁকিতে আটকে রাখে। এ অবস্থা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া বড্ড বেশি অসম্ভব।

মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানে না, এমন লোকের সংখ্যা খুব কম। মাদকাসক্তির দুর্ভোগ ও অপূরণীয় ক্ষতি কলমের বর্ণনায় শেষ করা কঠিন। বাংলাদেশ সরাসরি তেমন কোনো মাদকদ্রব্য উৎপাদন না করলেও ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আফিম উৎপাদন ও চোরাচালানের স্বর্গরাজ্য বলে খ্যাত পাকিস্তান, ইরান ও আফগানিস্তান সমন্বয়ে গঠিত গোল্ডেন ক্রিসেন্ট বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। আন্তর্জাতিকভাবে মাদক তৈরির উপাদান পপি উৎপাদনকারী অঞ্চল মিয়ানমার, লাওস ও থাইল্যান্ডের সমন্বয়ে গঠিত গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত। বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের সমন্বয়ে গঠিত মাদক পাচার ও চোরাচালানের রুট ‘গোল্ডেন ওয়েজ’ এদেশের চারপাশ জুড়ে রয়েছে। বাংলাদেশের এহেন অবস্থানগত কারণে উল্লিখিত দেশগুলো থেকে আন্তর্জাতিকভাবে মাদকপাচার, চোরাচালান ও সেবন রোধ করা খুব কঠিন। তবে একেবারে অসম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক রুটগত অবস্থান ও চোরাচালান এবং দেশীয় মাদক ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতায় এদেশে গাঁজা, ইয়াবা, হেরোইন, আফিম, কোকেন, প্যাথেডিন ইনজেকশন, ফেনসিডিল, মদ-তাড়ি, ভাং, মারিজুয়ানা, এলএসডিসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়। গাঁজা দেশীয়ভাবে উৎপাদন, মিয়ানমার থেকে চোরাপথে প্রচুর ইয়াবা প্রবেশ এবং প্রতিবেশী দেশ ভারতের সীমান্ত-পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো থেকে ফেনসিডিল খুব সহজে এদেশে আসে। অন্যান্য মাদক সহজপ্রাপ্য না হওয়ায় এগুলো প্রাপ্তিতে মাদকসেবীদের ছলচাতুরীর আশ্রয় গ্রহণ করা লাগে। তবে মাদক মানেই খারাপ কিছু তা নয়। আমরা যে ওষুধ সেবন করি, সেগুলোও উপকারী মাদক। যখন মাদক নেশার উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তখন সেটা অনৈতিক ও মারাত্মক ক্ষতিকর।

ইদানীং এলএসডির ভয়াবহ চিত্র সচেতন মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। এলএসডি (খুংবৎমরপ ধপরফ ফরবঃযুষধসরফব) এক ধরনের সাইকেডেলিক ওষুধ, যেটির মানবদেহে অপরিসীম মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব রয়েছে। এটির মাধ্যমে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতনতা, উপলব্ধি ও সংবেদনশীলতায় বিকৃত পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এলএসডির সবচেয়ে বড় প্রভাবÑএটির মাধ্যমে অবাস্তব ও কাল্পনিক চিত্রগুলো বাস্তব মনে হওয়া। এছাড়া এই মাদকটি প্রমোদ সৃষ্টিকারী ওষুধ হিসেবে এবং আধ্যাত্মিক প্রয়াসে ব্যবহার করা হয়। এটির ব্যবহার পদ্ধতিও একটু অভিনব ধরনের। এলএসডি সাধারণত জিভের নিচে রেখে ব্যবহার করা হয়। তবে এটি প্রায়ই বল্টার পেপার, চিনির কিউব ও জেলটিনে বিক্রি করা হয়। দাম বেশি হওয়ায় এলএসডি বাজারে মাইগ্রাম ইউনিটে বিক্রি হয়, যার কোনো কোনোটা দেখতে একেবারে আলপনার মতো। তবে এটি ইনজেকশনের সাহায্যেও নেয়া যায়। অভিনব পদ্ধতিতে সেবন ও দাম বেশি হওয়ায় তরুণ সমাজে এটা আভিজাত্য ও স্মার্টনেস প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। নতুনভাবে মাদকজগতে আসায় এলএসডির অপূরণীয় ক্ষতি সম্পর্কে অনেকে জানে না। তারা কাজ-কর্মে অধিক মনোযোগ এবং আড্ডাকে জমিয়ে তোলার জন্য গাঁজার অধুনা ভার্সন হিসেবে এটি সেবন করে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এই মাদক গ্রহণে হ্যালুসিনেশন (ভ্রান্তিবিলাস) অত্যন্ত পরিমাণে বেড়ে যায়। একপর্যায়ে সেবনকারী নিজেকে দৈত্যের মতো ক্ষমতাবান মনে করে। সে পাখির মতো ডানা মেলে উড়তে থাকে। তার অনেক পুরনো স্মৃতি-বিস্মৃতি ও নানা ঘটনা মনে পড়ে যায়। বেপরোয়া হয়ে এলএসডি সেবনকারীর মানসিক অবস্থা এমন অবস্থায় গিয়ে দাঁড়ায় যে, সে এমন কোনো কাজ নেই করতে পারবে না। সে কাজ হতে পারে নন্দিত, নিন্দিত বা গর্হিত। এককথায় সে হিতাহিত জ্ঞানহীন হয়ে নিজেকে পরিস্থিতি অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। কিছুদিন আগে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমান মতো টগবগে মেধাবী তরুণকে হারিয়েছি এই এলএসডির ভয়ালগ্রাসে। সে মানসিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমারজেন্সি গেটের ডাবের দোকান থেকে দা নিয়ে গলায় চালিয়ে দেয়। এরপর সে দৌড়ে হাসপাতালের বহির্বিভাগের গেটে গিয়ে অচেতন হয়ে লুটিয়ে পড়ে। পরে ঢাকা মেডিকেলের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।  চিন্তা করা যায়, কী ভয়াবহ মাদক এলএসডি! ইয়াবা ধ্বংস করছে আমাদের তরুণ সমাজকে। নতুনভাবে সমাজকে বিধ্বস্ত করতে আসছে এলএসডি।

মাদকাসক্তি রোধ করতে ব্যর্থ হলে আমাদের চরম মূল্য দিতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি আর না করি, মাদকে ভাসছে দেশ। এখনই ইয়াবা-এলএসডিসহ মাদকের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ালে আমাদের জন্য গভীর অন্ধকার অপেক্ষা করছে। যে আঁধারে আপনি মাদকমুক্ত থাকলেও নিজেকে চিনবেন না।

আরও ভীতিকর সংবাদ হলো পুলিশ তথ্য দিয়েছে, ঢাকা শহরে এলএসডি সেবন ও বেচাকেনার সঙ্গে ১৫টি দল সক্রিয় রয়েছে। অজানা আরও মাধ্যম আছে, যেখান থেকে তরুণসমাজ এই মাদকগ্রহণ করছে, যা হয়তো পরিবারসহ অনেকেই জানে না। বিশ্লেষকরা বলছে, এটা দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের একটা বাই-প্রডাক্ট হতে পারে। দীর্ঘদিন সরাসরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে পড়াশোনা করা থেকে দূরে থাকার কারণে অনেক শিক্ষার্থী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তারা হতাশা ও নির্বিকার জীবন থেকে পরিত্রাণ পেতে মাদক সেবনের মতো পন্থা বেছে নিচ্ছে। কেউ কেউ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে। অনলাইনে ক্লাস করার পারিবারিক স্বীকৃতি পেয়ে অনেক কোমলমতি ছেলে-মেয়ে পর্নগ্রাফি ও পাবজিসহ নানা অনলাইন গেমে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করার পাশাপাশি পরিবার ও সমাজকে নিয়ে যাচ্ছে অধঃপাতে। তবে আমাদের তরুণসমাজ যেহেতু অল্পদিন ধরে এলএসডি সেবনের পথে হাঁটছে, তাই সরকার ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার উচিত হবে এখনই এর রাশ টেনে ধরা। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে এলএসডি ভয়াবহতম মাদক হিসেবে আমাদের সামনে মহাবিপদ নিয়ে হাজির হবে, যা রোধ করা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাবে। এ অবস্থায় এলএসডিসহ অন্যান্য মাদকমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ করা সময়ের দাবি।

এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষক, গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ