বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে চলছে তৈরি পোশাকশিল্প। কিন্তু জ্বালানি সংকট, বিপর্যস্ত ব্যাংক খাত, বন্দর ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা, দুর্বল যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ বেশকিছু কারণে ধুঁকছে এ শিল্প। এ নিয়ে শেয়ার বিজের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু। সমসাময়িক ইস্যুতে কথা বলেছেন নূরউদ্দিন রানা
শেয়ার বিজ: এক কঠিন সময়ে বিজিএমইএ’র নেতৃত্বে আপনি অভিষিক্ত হয়েছেন। অভিনন্দন আপনাকে। এ সময়ে পোশাক খাতের চ্যালেঞ্জগুলো কী দেখছেন?
মাহমুদ হাসান খান (বাবু): আগেও আমি বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ নিয়ে কথা বলেছি। শুরুতে আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল আদৌ আমরা মানসম্পন্ন পোশাক বানাতে পারি কি না? এর পরে যে চ্যালেঞ্জগুলো এসেছে সেগুলো ছিল, চাইল্ড লেবার ইলিমিনেশন, কোটা ফেইজ আউট, তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিদুর্ঘটনা এবং রানা প্লাজা ধস। আমরা এগুলো মোকাবিলা করেছি। সামনেও নতুন চ্যালেঞ্জ আসবে এবং আমরা সেগুলো সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করব।
শেয়ার বিজ: এ সময়ে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চ্যালেঞ্জগুলো কী?
মাহমুদ হাসান: বর্তমানে আমাদের চ্যালেঞ্জ হলো-ইউএস ট্যারিফ ইস্যু, এলডিসি গ্রাজুয়েশন, বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ পরিস্থিতি। এ ছাড়া শাসনামল পরিবর্তনের পর প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে আমাদের একটা আনকমফোর্টেবল সিচ্যুয়েশন তৈরি হয়েছে ইত্যাদি। ইউএস ট্যারিফ যাতে সহনীয় পর্যায়ে থাকে, সেজন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে এবং বিজনেস কমিউনিটি থেকে। এরপর এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন প্রসঙ্গ। আমরা বহুদূর এগিয়ে এসেছি। অর্থনীতির বহুবিধ সূচকে আমাদের অগ্রগতি আছে। তবে আমাদের কিছু চ্যালেঞ্জ আছে এবং আমরা আপ টু দ্য মার্ক নই। অর্থাৎ পুরোপুরি প্রস্তুত নই, যেহেতু এটি ২০২৬ সালে না হয়ে দু-তিন বছর পরে হলে ভালো হয়। বৈশ্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের বিশেষ কিছু করার নেই।
শেয়ার বিজ: ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ইস্যুতে কী বলবেন?
মাহমুদ হাসান: শেখ হাসিনার আওয়ামী শাসনামল পরিবর্তনের পরে সম্পর্কের যে সংকট তৈরি হয়েছে সেটি জিটুজি’তে এবং ব্যবসায়ী পর্যায়ে আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক আছে। ব্যবসায়ীদের কাছে বিবেচ্য হলো, যখন যেখান থেকে আমরা ভালো মান, যৌক্তিক মূল্য ও সরবরাহের সময় বিবেচনায় সুবিধাজনক ও লাভজনক হয়, সেখান থেকে আমদানি করব। এখানে সম্পর্কের বিষয়টি বিবেচ্য নয়। তবে উভয় দেশের স্বার্থে, ব্যবসায়িক স্বার্থে সম্পর্কটি যেন জিটুজিতে সহজ স্বাভাবিক হয়, সেই চেষ্টা উভয় দেশের ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আশা করি।
শেয়ার বিজ: এবার অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ, এগুলো মোকাবিলায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেবেন?
মাহমুদ হাসান: অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো জ্বালানি সংকট এবং ব্যাংকের উচ্চ সুদ হার। জ্বালানির ক্ষেত্রে যদি আরও সুনির্দিষ্ট করে বলি, গ্যাসের সরবরাহ সংকট। এ মুহূর্তে গ্যাস উৎপাদন এলএনজি আমদানিনির্ভর। তবে এটি যেন সঠিক পরিকল্পনামতো হয়, সেটি আশা করি। যাতে এই আছে, এই নেইÑএমন পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়। যেহেতু এখন তুলনামূলকভাবে ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ স্টেবল এবং সামনে আরও ভালো হওয়ার সম্ভাবনা আছে, সুতরাং এ পর্যায়ক্রমে সাইড বাই সাইড গ্যাস উত্তোলন, যেটি এত দিন বন্ধ ছিল, তা চালু করতে হবে। অন্যদিকে ভোলায় যে গ্যাস আছে, সেটির যেন সঠিক ব্যবহার হয়, সেই প্রচেষ্টা নিতে হবে। ভোলার গ্যাস ক্ষেত্রটি দ্বীপে অবস্থিত, সে কারণে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে এটিকে দ্রুততম সময়ে সংযোগ করতে হবে। অন্যদিকে সাস্টেইনেবল এনার্জি অর্থাৎ সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট যেখানে যেখানে করা সম্ভব, তা দ্রুত করতে হবে। আগের আমলের মতো বিলম্বিত কিংবা দুর্নীতিগ্রস্ত হলে হবে না। সিদ্ধান্তগুলো দ্রুত নিলে জ্বালানি সংকটের কার্যকর সমাধান মিলবে।
শেয়ার বিজ: মুদ্রাস্ফীতি, ব্যাংক সুদের উচ্চ হার এবং ব্যাংক খাতের বিপর্যস্ত অবস্থা প্রসঙ্গে বলুন।
মাহমুদ হাসান: মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় জড়িত। এটি দ্রুত সহনীয় পর্যায়ে রাখার চেষ্টা হচ্ছে। ধীরে ধীরে কমে আসছে। মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে ব্যাংক ঋণের সম্পর্ক আছে। ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, নন-পারফর্মিং লোন। এটি আবার দু’ ধরনের; একটি প্রকাশ্য এবং অপরটি লুক্কায়িত অর্থাৎ হিডেন। হিডেনগুলো এখন সারফেসে আসছে, এটি ইতিবাচক। নন-পারফর্মিং লোনের গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড ২ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে এটি অত্যধিক বেশি, যা জাতীয় অর্থনীতিকে কঠিন চ্যালেঞ্জে ফেলে দিয়েছে। এ ছাড়া কোন ব্যাংকের পারফরম্যান্স ভালো, কোনটি আবার বেশি খারাপ। যা হোক, সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে সুশাসন ও শৃঙ্খলা ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে, নিচ্ছে। এগুলো আমরা সাপোর্ট করি। আশা করি, দ্রুত ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে, যাতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পায়নে ব্যাংকগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
শেয়ার বিজ: পোশাক খাতের উন্নয়নে আপনার নেতৃত্বে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে?
মাহমুদ হাসান: নির্বাচিত হওয়ার পর এ খাতের উন্নয়নে কিছু এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছি আমরা। যেমন, কাস্টমসের অডিট প্রক্রিয়া সহজ করা, এসএমই’কে সাপোর্ট দেয়া, স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় গড়ে তোলা এবং রুগ্ণ শিল্পগুলোর জন্য এক্সিট পলিসি প্রণয়ন প্রভৃতি। আমরা চাই না, কেউ এসএমই নিয়ে আজীবন পড়ে থাকুক। এ ছাড়া ৪৬ বছর নেতৃত্বে না থেকেও যারা পোশাকশিল্পের উন্নয়নে নিবেদিতভাবে কাজ করে গেছেন এবং সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন, তাদের সম্মানে ‘হল অব ফেইম’ গড়ে তোলার বিষয়েও কাজ চলমান আছে।
শেয়ার বিজ: বাংলাদেশের বন্দর ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত নাজুক, যা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। এ বিষয়ে কী বলবেন?
মাহমুদ হাসান: একটি দেশের অর্থনীতির জন্য বন্দর ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের দ্বারপ্রান্তে এসে যদি আমরা বন্দর ব্যবস্থাপনায় দক্ষ হতে না পারি, বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে না পারি, তাহলে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। এজন্য দক্ষতার সঙ্গে এবং যৌক্তিক ট্যারিফ কাঠামোয় যারা অপারেট করতে পারবে, তাদের নিয়ন্ত্রণে যাওয়াই শ্রেয়। তা দেশি কি না বিদেশি, তা আমাদের বিবেচ্য নয়। তবে সার্বভৌমত্বের জন্য যেন তা হুমকি না হয়, সেটি গুরুত্বপূর্ণ।
শেয়ার বিজ: শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় পণ্য পরিবহন নেটওয়ার্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিযোগিতা সক্ষমতার বিবেচনায় সেটি কেমন হওয়া উচিত।
মাহমুদ হাসান: অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির স্বার্থে নদী, সড়ক ও রেলপথ-এই তিনের সমন্বয়ে কার্যকর সাশ্রয়ী যোগাযোগ ও পরিবহন নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা জরুরি। রপ্তানি পণ্য হোক, কিংবা অভ্যন্তরীণ বাজারের ভোগ্যপণ্যই হোক, সড়ক পথটি ব্যয়বহুল এবং বাংলাদেশে এটি নাজুক। সব বিবেচনায় রেলপথ যোগাযোগ নেটওয়ার্কটি বিস্তৃত ও কার্যকর করা আবশ্যক মনে করি।
শেয়ার বিজ: উন্নত বিশ্বের দেশগুলো শিল্পের কেন্দ্রীয়করণ নীতি এবং প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীয়করণ নীতি অনুসরণ করছে। বাংলাদেশে এ দুটি বিষয় উপেক্ষিত। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।
মাহমুদ হাসান: রাষ্ট্র পরিচালনার দক্ষতা বৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতার বিবেচনায় এবং বৈষম্যহীন কার্যকর পরিষেবা ব্যবস্থাপনার জন্য উন্নত দেশগুলো প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ নীতি অনুসরণ করছে বহুকাল ধরেই। অন্যদিকে শিল্পের উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শ্রমিক শ্রেণির জীবনমান উন্নয়নে শিল্পের কেন্দ্রীয়করণ নীতি অনুসরণ করেই গড়ে উঠেছে শিল্পোন্নত দেশগুলো। কিন্তু আমরা রাজধানীকেন্দ্রিক উন্নয়ন ও প্রশাসনিক কেন্দ্রীয়করণে নীতিতে আটকে আছি। ফলে আমলাতান্ত্রিক গ্যাঁড়াকলে, লালফিতার দৌরাত্ম্যে দিশাহারা। অন্যদিকে অনুসরণ করা হচ্ছে না শিল্পের কেন্দ্রীয়করণ নীতি। ফলে বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে উঠেছে শিল্পকারখানা। সেটিও আবার রাজধানী শহরে কিংবা এর নিকটতম জেলাগুলোয়। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কলকারখানায় গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা, পরিষেবা দান; অগ্নিকাণ্ড ও দুর্ঘটনা প্রতিরোধ সম্ভব হয় না। এলডিসির জন্য আমাদের হতে হবে অধিক উৎপাদনশীল; অধিক প্রতিযোগিতা সক্ষম; দক্ষ, কার্যকর ও সাশ্রয়ী। এজন্য প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও শিল্পের কেন্দ্রীয়করণ নীতি অনুসরণের বিকল্প নেই। এলডিসি-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা বিবেচনায়ও এই দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ।
জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে সংস্কারের যে তাগিদ উপলব্ধি করছি, প্রক্রিয়া চলছে এবং এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের যে স্বপ্ন লালন করছি আমরাÑএসবের বাস্তব রূপায়ণে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও শিল্পের কেন্দ্রীয়করণ নীতি অনুসরণে পদক্ষেপ নেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, এমনটি প্রত্যাশা করছি।
শেয়ার বিজ: মূল্যবান সময় ও মতামতের জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
মাহমুদ হাসান: আপনাকেও ধন্যবাদ।