এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের পথে স্বপ্নযাত্রা: প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জ

মুছা কালিমুল্লা: সত্তরের দশকে স্বাধীন হওয়া অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা পাওয়া একটি দেশের পক্ষে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়া নিঃসন্দেহে গৌরবের ও অর্জনের বিষয়। এটি নিঃসন্দেহে বিশ্বের বুকে আমাদের সক্ষমতার প্রতিচ্ছবি ও ইতিবাচক ভাবমূর্তির বহিঃপ্রকাশ। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৪ সালের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে আসতে পারে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যখন বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হবে। এ সময়টি ২০২৬ সাল পর্যন্ত বর্ধিতও হতে পারে। যদিও প্রথম দৃষ্টিতেই সংবাদটি আমাদের জন্য অনেক আনন্দের মনে হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশে কি প্রস্তুত এত বড় সম্মান বহন করার জন্য! বাংলাদেশ কি পারবে এত বড় সম্মান কাঁধে করে নিয়ে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যেতে! এগুলো সব প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন।

কোনো দেশের স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সুপারিশ পাওয়ার ক্ষেত্রে কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। যদি কোনো দেশ নির্দিষ্ট তিনটি মানের (মাথাপিছু আয়, মানব উন্নয়ন, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে) নির্ধারিত মান অর্জন করতে পারে, তখন সে দেশকে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার জন্য সুপারিশ করে সিডিপি। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকটি অবশ্যই ৩২ পয়েন্ট বা তার নিচে হতে হবে। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ বা এর বেশি পয়েন্ট পাওয়া উচিত। মাথাপিছু আয়ের সূচকটি এক হাজার ২৩০ মার্কিন ডলার থাকতে হবে এবং প্রথমবার সুপারিশ করার পর পরবর্তী তিন বছর পর্যবেক্ষণ করা হয় যে, ওই দেশটি নির্ধারিত মান বজায় রাখতে পারছে কি না। দ্বিতীয়বার পর্যবেক্ষণ করার পর যদি প্রতীয়মান হয় দেশটি নির্দিষ্ট মান বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে, তাহলে সিডিপি ওই দেশকে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার জন্য চূড়ান্তভাবে সুপারিশ করে। প্রথমবার ২০১৮ সালের মার্চে সিডিপির মূল্যায়নে তিনটি সূচকেই বাংলাদেশ নির্দিষ্ট মান অর্জন করেছিল। এবার তিন বছর পর ২০২১ সালের মূল্যায়নেও তিনটি সূচকের তিনটিতেই প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত মান অর্জন করেছে আমাদের বাংলাদেশ।

এর ফলে সিডিপি বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার জন্য চূড়ান্তভাবে সুপারিশ করেছে এবং এটার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে আরও তিন বছর সময়ের প্রয়োজন। সুতরাং ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারে।

সিডিপির বর্তমান বিধান অনুযায়ী, উত্তরণের সুপারিশ পাওয়ার পর একটি দেশ তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত প্রস্তুতিকাল ভোগ করতে পারবে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে সিডিপির কাছে প্রস্তুতির জন্য পাঁচ বছর সময় চাওয়া হয়েছে। সুতরাং এই সময়টা ২০২৬ সাল পর্যন্ত বর্ধিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে শুরু হবে বাংলাদেশের নতুন বিশ্বের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং সীমাহীন সম্ভাবনার খোঁজে কঠিনতর যাত্রা। এ পর্যায়ে বাংলাদেশের সামনে নতুন নতুন অনেক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ আসবে। আর তা মোকাবিলায় বাংলাদেশ কতটা সক্ষম হবে সেটাই বিবেচ্য বিষয়।

এলডিসি থেকে উত্তরণের পর আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। সিপিডির মতে, সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হবে রপ্তানি খাতে। যেসব বাজার বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর তা আর থাকবে না। এতে রপ্তানি প্রতি ১০০ টাকায় আগের চেয়ে সাড়ে সাত টাকা বেশি দিতে হবে। ফলে তখন প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য উৎপাদনশীলতা বাড়ানো একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এছাড়া আবহাওয়াগত বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে আছে বিশ্ব। সেগুলোকে মোকাবিলা করার বিষয় উঠবে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডাব্লুউটিও) মতে, বাংলাদেশের বর্তমান রপ্তানি পণ্যের শীর্ষ ১২টির গন্তব্যে ৭০ শতাংশ পণ্য বাণিজ্য সুবিধার আওতাভুক্ত রয়েছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পরে সে সুবিধা আর থাকবে না। এ কারণে বাজারসুবিধা হারিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ৬২ শতাংশের গন্তব্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা (জিএসপি) থাকায় এ বাজারে কোনো শুল্ক না দিয়েই বাংলাদেশি পণ্য প্রবেশ করতে পারে। এলডিসি থেকে বেল হওয়ার পর এই সুবিধা আর থাকবে না। অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্ব^ী ভিয়েতনাম ইইউ’র সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (অফটিএ) করার কারণে বাংলাদেশের পোশাক বাণিজ্য ইউরোপের বাজারে প্রচণ্ড প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়বে।

আর তাছাড়া বাংলাদেশ ইউরোপের বাজারে দ্বিতীয় শুল্ক সুবিধা জিএসপি প্লাস অর্জন করার আগেই এলডিসি থেকে বের হতে যাচ্ছে। এটা আরেকটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। আর এর ফলে রপ্তানি খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ ৫৩৭ কোটি ডলার বা ৪৫ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা কমতে পারে, যা দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ১৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। আবার বৈদেশিক ঋণে সহনীয় সুদ ও নমনীয় শর্তও সীমিত হয়ে আসবে। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে আগের মতো সহজ শর্তে বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য পাবে না বাংলাদেশ। ফলে বাংলাদেশকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হবে। এ প্রক্রিয়ার সঠিক সমন্বয় না হলে অভ্যন্তরীণ অর্থ ব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়তে পারে।

এলডিসির আওতাভুক্ত হওয়ায় জাতিসংঘের যেকোনো প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করার জন্য বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের বিমানভাড়া জাতিসংঘ বহন করত, কিন্তু যখন বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হয়ে যাবে, তখন সম্পূর্ণ খরচ বাংলাদেশ সরকারকে বহন করতে হবে। এলডিসির আওতাভুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশ যেসব বৈদেশিক সাহায্য ও প্রণোদনা লাভ করত, সেগুলো অধিকাংশ বন্ধ হয়ে যাবে। বিদেশে অধ্যয়নরত যেসব বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এলডিসিভুক্ত দেশের শিক্ষার্থী হওয়ার জন্য বৃত্তির সুযোগ পেত, সেগুলো সীমিত হওয়ার শঙ্কা দেখা দেবে। তাছাড়া জাতিসংঘ কর্তৃক বাংলাদেশের ওপর ধার্য চাঁদার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। সর্বোপরি বলা যায়?, করোনা-পরবর্তী বিশ্ব বাণিজ্যে এলডিসির সুবিধা হারিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

এলডিসি থেকে উত্তরণের পর প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব বাণিজ্যে টিকে থাকতে এবং সামনের উন্নয়নশীল দেশের পথে যাত্রা মসৃণ করতে বাংলাদেশকে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে গার্মেন্ট ছাড়াও আরও অনেক রপ্তানি পণ্য তৈরি করতে হবে। শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের শুধু কয়েকটি রপ্তানিকারক পণ্যের ওপরে দৃষ্টিপাত না করে রপ্তানির বহুমুখীকরণ করতে হবে।

বর্তমান নিয়মে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারে বাংলাদেশ ২০২৬ সালের পর আরও তিন বছর অর্থাৎ ২০২৯ সাল পর্যন্ত শুল্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করতে পারবে। সুতরাং এই সময়ের মধ্যে যত দ্রুত সম্ভব আমাদের জিএসপি প্লাসভুক্ত দেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। যদি আমরা এলডিসি থেকে উত্তরণের আগেই জিএসপি প্লাসভুক্ত দেশের অন্তর্ভুক্ত হতে পারি, তাহলে বর্তমান সময়ের মতো ইউরোপের বাজারে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করার সুযোগ তৈরি হবে। বাংলাদেশ সরকারকে যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশি পণ্যের প্রধান গন্তব্য দেশগুলোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করতে হবে। এখন পর্যন্ত ভুটানের সঙ্গে একটি এফটিএ হয়ে গেছে।

শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়