নিজস্ব প্রতিবেদক: জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টগুলো (এসডিজি) অর্জনে সঠিক পথে নেই বাংলাদেশ। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিচার-বিশ্লেষণ করার মতো তথ্য-উপাত্ত পর্যন্ত নেই। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ও নাগরিক সংলাপকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক মূল্যায়ন প্রতিবেদন এ তথ্য উঠে এসেছে।
‘চার বছরে বাংলাদেশের এসডিজি বাস্তবায়ন মূল্যায়ন: বেসরকারি খাতের ভূমিকা’ শীর্ষক এক সংলাপে এসব বিষয় উল্লেখ করেছে সিপিডি। রাজধানীর লেকশোর হোটেলে গতকাল এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।
সিপিডির ভাষ্যমতে, বৈষম্য দূরীকরণ, শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা, কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের এখনও কার্যকর অগ্রগতি হয়নি। তবে সবার জন্য শিক্ষা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে প্রাথমিকভাবে সাফল্য এসেছে। এসডিজি অর্জনে সফল হতে হলে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে জবাবদিহি এবং সুশাসন নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি। এছাড়া কয়েকটি ক্ষেত্রে নীতিগত ব্যাপক সংস্কারের দাবি করা হয়েছে।
সিপিডি ও এশিয়া ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এ সংলাপের আয়োজন করে। সংলাপে জাতীয় সংসদের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত ড. রেনে হোলেস্টেইন, জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সেপ্পো, সিপিডির চেয়ারপারসন ড. রেহমান সোবহান, সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান ও নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনসহ অন্যরা বক্তব্য রাখেন।
এদিকে জাতিসংঘ ঘোষিত ১৫ বছরমেয়াদি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বা এসডিজি অর্জনে জাতীয় সংসদে আলাদা একটি অধিবেশন আহ্বানের পরামর্শ দিয়েছেন সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, এতে সরকারের উচ্চপর্যায়ে এসডিজি নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের মতামত পাওয়া যাবে। এছাড়া সরকারের উচ্চপর্যায়ে এক ধরনের জবাবদিহি তৈরি হবে।
সংলাপে এসডিজির ১৭টি অভীষ্টের মধ্যে ছয়টির ২০১৫ থেকে ২০১৯ সময়কালের বাস্তবায়ন অগ্রগতি তুলে ধরেন ড. ফাহমিদা খাতুন। ওই ছয়টি অভীষ্ট হলো শিক্ষা, শোভন কাজ, বৈষম্য, জলবায়ু রক্ষা পদক্ষেপ, শান্তি ও ন্যায়বিচার এবং বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব। শিক্ষা, অংশীদারিত্ব ও শোভন কাজ এ তিনটি অভীষ্ট অর্জনে বাংলাদেশ মোটামুটি সঠিক পথে রয়েছে। কিন্তু নীতিগত অনেক সংস্কার প্রয়োজন। বৈষম্য, জলবায়ু রক্ষায় পদক্ষেপ এবং শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জনে ভুলপথে রয়েছে বাংলাদেশ।
২০৩০ সালের মধ্যে অভীষ্টগুলো অর্জনে বিদ্যমান নীতিতে ব্যাপক সংস্কার এবং সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। রেহমান সোবহান বলেন, এসডিজির অভীষ্টগুলো বাস্তবায়নে সরকারের মূল কাজের অংশ হিসেবে নিতে হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এসডিজি নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা পর্যন্ত হয়নি। অথচ জনপ্রতিনিধিরা দেশের তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন। তার মতে, পুরো এসডিজি অর্জন বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণের কথা খুব বেশি আলোচনা হচ্ছে না। পুরোটা যেন সরকারের বাস্তবায়নের বিষয়। তিনি সুশীল সমাজকে এসডিজি অর্জনে সম্পৃক্ত করার তাগিদ দেন।
মিয়া সেপ্পো বলেন, এসডিজি অর্জনে উভয়পক্ষীয় সংলাপ চলমান রাখতে হবে। জবাবদিহিমূলক অংশীদারিত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক অর্থনৈতিক রূপান্তরের মাধ্যমে এসডিজি অর্জন করতে হবে। তার মতে, বেসরকারি খাত হলো একটি দেশের ডিএনএ।
সুইডিশ রাষ্ট্রদূত ড. রেনে হোলেস্টেইন বলেন, এসডিজি অর্জনে সামাজিক আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ। এ আন্দোলনের অংশ হিসেবে চিন্তা, কাজ ও উন্নয়ন রূপরেখায় বেসরকারি অংশীদারিত্ব প্রয়োজন। তবে এটি যেন শুধু ফ্যাশনে পরিণত না হয়। কোনোভাবেই নাগরিক সমাজের কথা বলার জায়গা সঙ্কুচিত করা যাবে না। তাহলে এসডিজি অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে এসডিজি বাস্তবায়নে অন্তর্ভুক্ত করে কাজ করে যাচ্ছে এটি ভালো দিক।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অনেক লক্ষ্য অর্জনে সঠিক পথে রয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু সেটি আবার গুণগত মানসম্পন্ন হচ্ছে কি নাÑতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। শিক্ষায় অগ্রগতি হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষিত বেকারত্ব বাড়ছে। এমন শিক্ষা দেওয়া যাবে না যে শিক্ষাকে বাজার স্বীকৃতি দেয় না। তাই এখনই ভাবতে হবে শুধু সনদ অর্জন নয়, এমন শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে যেটি কাজে লাগে। সংখ্যার আধিক্য নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চলবে না। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, বৈষম্য এবং ন্যায়বিচারে আমরা ভালো করছি না।’ তিনি মনে করেন, বৈষম্য থাকলে অন্য অভীষ্টগুলো অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে।
অনুষ্ঠানে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, মানসম্পন্ন শিক্ষা ছাড়া কোনো কিছুই অর্জন করা যাবে না। প্রথম শ্রেণি থেকে ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত। ১২ বছর পড়াশোনা করেও শিক্ষার্থীরা তিন পাতা ইংরেজি লিখতে পারে না।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ জানান, সরকার এসডিজি অর্জনে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কাজ করে যাচ্ছে। এসডিজি অর্জনে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বেশি লাগবে।
সংলাপে দুটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান এসডিজি বাস্তবায়নে বেসরকারি খাতের ভূমিকা এবং নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন এসডিজি অগ্রগতি নিয়ে দুটি উপস্থাপনা দেন। অনুষ্ঠানে এ সংক্রান্ত দুটি বইয়ের মোড়ক উম্মোচন করা হয়।