ঐতিহ্যবাহী ঢাকার ভবিষ্যৎ কোন দিকে?

মো. আলমামুন: ঢাকা বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন শহর এবং বর্তমানে বাংলাদেশের রাজধানী। বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায়, খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক থেকে ঢাকায় মানুষ বসবাস করতে শুরু করে। ঢাকার সন্নিকটে বিক্রমপুরে সেনদের রাজধানী ছিল। সেন-পরবর্তী যুগে ঢাকা তুর্কি ও আফগান শাসনাধীন ছিল। এ সময় ঢাকা দিল্লি সালতানাত-নির্ধারিত শাসকদের দ্বারা শাসিত হয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে পুরান ঢাকা মুঘল সাম্রাজ্যের সুবহে বাংলার প্রাদেশিক রাজধানী ছিল। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে ১৬১০ সালে ঢাকা প্রথম রাজধানীর মর্যাদা পায়। সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্যে দুর্বলতা দেখা দেয়ায় ১৮ শতকের শুরুতে ঢাকা থেকে রাজধানী মুর্শিদাবাদে সরিয়ে নেয়া হয়। এসময় বিশ্বব্যাপী মসলিন বাণিজ্যের একটি কেন্দ্র ছিল ঢাকা এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা এখানে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আসতেন। মুঘল-পরবর্তীযুগে ঢাকা প্রায় ২০০ বছর ব্রিটিশ শাসনাধীন থাকে। এসময় আধুনিক ঢাকার বিকাশ ঘটে। ব্রিটিশ শাসনামলে নবাবরা ঢাকা শাসন করতেন। এসময় কলকাতার পরে ঢাকা বাংলা প্রেসিডেন্সির দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী হয়ে ওঠে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পর ঢাকা নবগঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী হয়। পরে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ঢাকা পূর্ববঙ্গের রাজধানী হিসেবে পাকিস্তানের অন্তর্গত হয়। ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে এই শহর বিভিন্ন সামাজিক, জাতীয়তাবাদী ও গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ১৯৫৬ সালে ঢাকাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়। ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী ঢাকাকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

ঢাকা শহর ‘মসজিদের শহর’ নামে সুপরিচিত। এই শহরে রোজ প্রায় পাঁচ লাখ রিকশা চলাচল করে। বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান সংস্কৃতি, শিক্ষা ও বাণিজ্যকেন্দ্র। ঢাকার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছেÑমুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, লালবাগের কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, হাতিরঝিল, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, বায়তুল মোকাররম মসজিদ, তারা মসজিদ, ঢাকেশ্বরী মন্দির, আর্মেনীয় গির্জা প্রভৃতি।

ভৌগোলিকভাবে ঢাকা বাংলাদেশের মধ্যভাগে বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত। ঢাকার নগরাঞ্চলীয় অবকাঠামোটি বিশ্বে সর্বোন্নত হলেও দূষণ, যানজট ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে যথেষ্ট পরিষেবার অভাবে শহুরে সমস্যাগুলো এখানে প্রকট। সাম্প্রতিক দশকগুলোয় ঢাকার পরিবহন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও গণপূর্ত ব্যবস্থায় যে আধুনিকীকরণ হয়েছে, তা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এর মধ্যে মেট্রোরেল প্রকল্প ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে উল্লেখযোগ্য। সারাদেশ থেকে প্রচুর মানুষ ঢাকায় আসে জীবন ও জীবিকার সন্ধানে। এ কারণে ঢাকা হয়ে উঠেছে বিশ্বের দ্রুততম ক্রমবর্ধমান নগরী। বর্তমানে ঢাকা মহানগরী এলাকার জনসংখ্যা প্রায় দুই কোটি ১৭ লাখ। জনসংখ্যার বিচারে ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম শহর। জনঘনত্বের বিচারে ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর। ৩০৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই শহরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৩ হাজার লোক বসবাস করে। অতিরিক্ত এই জনসংখ্যার চাপে ঢাকা শহরে সমস্যার অন্ত নেই। কর্মসংস্থানের অভাব, আবাসন সংকট, যানজট, বস্তি সৃষ্টি, পরিবেশ দূষণ, বিভিন্ন রোগব্যাধির আনাগোনা প্রভৃতি শহরের মানুষকে করেছে বিষাক্ত। ঘটছে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা নগরী কখনও বসবাসের অযোগ্য নগরী আবার কখনও বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরীর খেতাবে ভূষিত হয়েছে। এসব নেতিবাচক খেতাব বছরের পর বছর ধরেই চলছে।

সাম্প্রতিক ঢাকা শহর নিয়ে একটি উদ্বেগজনক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ঢাকাবাসীর কর্মক্ষমতা কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রের একদল গবেষক যৌথভাবে বিশ্বের ৫০টি শহরের ওপর গবেষণা করেছে। তাতেই উঠে এসেছে এসব তথ্য। বিশ্বের এমন ২৫টি দেশের মধ্যে ভারত শীর্ষে, আর বাংলাদেশ দ্বিতীয়। গবেষণায় বলা হয়েছে, বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাবে ঢাকাবাসীর কর্মক্ষমতা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে বছরে এ শহরে মোট পাঁচ কোটি ৭৫ লাখ মানুষ (বিভিন্ন কাজে ঢাকার বাইরে থেকে আসা মানুষসহ) তাদের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতার চেয়ে কম কাজ করতে পারছে। তারা বলেছেন, শহরের তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে সেটাকে ‘চরম উষ্ণ’ বলা হয়। উল্লেখ্য, ঢাকা শহরে স্বাভাবিক সময়েও তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক পরিবেশের অভাব, জলাশয় না থাকা এবং কংক্রিটের ইমারত ও স্থাপনা তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর পাশাপাশি জনসংখ্যার আধিক্য তো আছেই।

বিরূপ পরিবেশ ও তাপমাত্রা ঢাকা শহরের মানুষের কর্মক্ষমতা যে শুধু কমিয়েছে তা নয়। অসহনীয় যানজটও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, যানজটে প্রতিদিন মানুষের ৩২ লাখ বা তার বেশি কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যানজটের কারণে কর্মজীবী মানুষের বছরে যে পরিমাণ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, তার আর্থিক মূল্য ৪৩ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যানজটের কারণে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি বা জিডিপির ক্ষতির পরিমাণ সাত শতাংশ। যানজটের এই আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি স্বাস্থ্যগত ক্ষতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। পরিবেশদূষণ, বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণে নগরবাসীর স্বাস্থ্যগত ক্ষতি কত হয়, তার সঠিক হিসাব পাওয়া মুসকিল। পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু ঢাকা শহরে বায়ুদূষণজনিত রোগে বছরে মারা যায় ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষ। বায়ুদূষণ নগরবাসীকে সেøা পয়জনিংয়ের মাধ্যমে মৃত্যুর দিকে ঢেলে দিচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানা, যানবাহন ও আশেপাশে গড়ে ওঠা ইটভাট থেকে সিসা-মিশ্রিত ধোঁয়া বাতাসকে দূষিত করছে। সরকারি এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় দেড় সহস্রাধিক সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রতিদিন ২০০ টন ক্লিনিক্যাল বর্জ্য উৎপাদিত হয়। কঠিন, তরল, রাসায়নিক ও তেজস্ক্রিয়Ñএই চার ধরনের বর্জ্য সাধারণ বর্জ্যরে মতো সিটি করপোরেশনের ডাস্টবিন ও নর্দমায় ফেলা হচ্ছে। এসব ক্লিনিক্যাল বর্জ্য নগরবাসীর জন্য ভয়াবহ ও মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি হয়ে রয়েছে। ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় সমস্যা জনসংখ্যার আধিক্য। বিশ্বব্যাংকের এক হিসাবে দেখা যায়, ঢাকার পশ্চিমাংশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪১ হাজার মানুষ বসবাস করে। যেখানে নিউইয়র্কে প্রতি একরে বাস করে ২৫-২৬ জন, সেখানে ঢাকায় বসবাস করছে ৫০০ থেকে ৬০০ জন।

বিশ্বের ৩৬টি মেগাসিটির মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৬। একটি মেগাসিটির যে মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো থাকা দরকার, তা ঢাকার আছে। তবে শহরটি পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেনি। একটি আদর্শ শহরে যান চলাচলের জন্য ২৫ শতাংশ সড়ক প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকার আছে মাত্র আট শতাংশ। এর মধ্যে ৪৪ শতাংশ সড়কে ফুটপাত নেই এবং ৮২ শতাংশ ফুটপাতের অবস্থা করুণ। আবার এসব সড়কের মধ্যে ৮০ শতাংশ সড়ক সরু ও অপরিকল্পিত। ফলে কোনো দুর্ঘটনা বা অগ্নিকাণ্ডের সময় অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয় নগরবাসীকে। যানজটের প্রধান কারণ সম্পর্কে নগরবিদরা বলছেন, পূর্ব-পশ্চিমমুখী সংযোগ সড়ক না থাকা, রিং রোডের অনুপস্থিতি, ট্রাফিক ব্যাবস্থাপনায় যথাযথ প্রযুক্তির অভাব, পার্কিংয়ে কোনো শৃঙ্খলা না থাকা, জনসংখ্যার আধিক্য প্রভৃতি। যানজটের সমস্যার সঙ্গে বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা যুক্ত হয়ে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। ঢাকা নগরীর জলাবদ্ধতা নিয়ে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, ঢাকার ৬০ শতাংশ এলাকায় ওয়াসার কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। কোনো দেশের মেগাসিটির ড্রেনেজ ব্যবস্থা এমন হতে পারে, তা কল্পনাতেও আসে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহরের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। বিগত এক দশকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২০ মিটার নিচে নেমে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতিবছর এ স্তর দুই দশমিক ৮১ মিটার করে কমছে। এর ফলে মাটির স্তর দেবে যাচ্ছে এবং ভূমিকম্পের আশঙ্কাও বাড়ছে।

ঢাকা শহরের এত সমস্যা দেখে মনে পড়ে যায় জার্মানির সমাজবিজ্ঞানী অসওয়াল্ড স্পেংলারের একটি তত্ত্বের কথা। তিনি বলেছেন, প্রতিটি সভ্যতা মানুষের জীবনচক্রের মতো চারটি ধাপ অতিক্রম করে। মানুষের জীবনচক্রে যেমন জš§-যৌবন-বার্ধক্য-মৃত্যু আসে, তেমনি কোনো সভ্যতার প্রথমে উদ্ভব ঘটে, তারপর সেটা বিভিন্নভাবে বিকশিত হয়, তৃতীয় পর্যায়ে মানুষ সেই সভ্যতার ফলভোগ করতে থাকে এবং শেষ পর্যায়ে বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে সেই সভ্যতার পতন ঘটে। উদাহরণ হিসেবে তিনি আটটি প্রাচীন সভ্যতা, যেমন মিশরীয়, ব্যাবিলনীয়, সুমেরীয়, গ্রিক, রোমান প্রভৃতি সভ্যতার কথা বলেছেন। ঢাকা শহরের বর্তমান সমস্যাগুলোর জন্য এখানে বসবাস করা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। তাহলে কি ঢাকা শহরও প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মতো পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাবে, নাকি সব সমস্যার সমাধান করে আধুনিক ঢাকায় পরিণত হবে? ভবিষ্যৎ কোন দিকে অগ্রসর হচ্ছে, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষায়।

শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়