ওষুধ শিল্পের স্বনির্ভরতা অর্জনে উদ্যোগ নিন

ওষুধ আমাদের বড় সম্ভাবনাময় শিল্প। এ খাতে সাফল্যও বিস্ময়কর। অতিমারি কভিডের অভিঘাতে যখন দেশের বেশিরভাগ শিল্পের আয় ব্যাপক কমেছে, তখন বিপরীত চিত্র ছিল ওষুধ শিল্প খাতে। ওই সময় দেশের ওষুধের বাজারে ঈর্ষণীয় প্রবৃদ্ধি হয়েছে। প্রতি বছর দেশীয় চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করে ওষুধ রপ্তানি হয় বিশ্বের প্রায় ১৬০ দেশে। রপ্তানি-আয় প্রতি বছরই বাড়ছে, জীবনরক্ষাকারী ওষুধও তৈরি হচ্ছে দেশে। কিন্তু সে অর্থে বাজার সম্প্রসারণ করতে পারিনি আমরা।
বিভিন্ন সময় স্বাস্থ্যসেবা খাতের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি দেশে-বিদেশে আমাদের সুনাম ক্ষুণœ করলেও ওষুধের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেনি কেউ। বরং আমাদের বেশ কয়েকটি ওষুধ ‘নিরাপদ ও কার্যকর’ বলে স্বীকৃতি ও ব্যবহারে অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ), যুক্তরাজ্যের মেডিসিন অ্যান্ড হেলথকেয়ার প্রোডাক্টস রেগুলেটরি এজেন্সি (এমএইচআরএ), ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (জিএমপি), গুডস থেরাপিউটিক গুডস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনসহ (টিজিএ অস্ট্রেলিয়া) উন্নত দেশগুলোর ওষুধ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
এত সাফল্য-অর্জন সত্ত্বেও আমাদের বড় সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা হলো ওষুধের কাঁচামাল বেশিরভাগই আমদানি করে আনতে হয়। বর্তমানে কমবেশি পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি পরিমাণে ওষুধের কাঁচামাল বা অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রিডিয়েন্ট (এপিআই) বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু ডলার সংকটসহ নানা কারণে এপিআই আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয়। ফলে জীবন রক্ষাকারী অনেক ওষুধের উৎপাদন বিঘিœত হয়ে থাকে।
‘ওষুধশিল্পে পরনির্ভরতা কমানোর তাগিদ স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের’ শীর্ষক যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে গতকালের শেয়ার বিজে, তা আমাদের ওষুধশিল্পের জন্য সুখবরই বলা যায়। তথ্য মতে, সুলভ মূল্যে ওষুধপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে দেশেই সব ধরনের ওষুধের কাঁচামাল তৈরির প্রস্তাব দেবে কমিশন। এতে থাকছে জোরালো নীতি সহায়তা ও প্রণোদনা সুপারিশ।
স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রধান জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান বলেছেন, দেশীয় ব্যবস্থাপনায় কাঁচামাল তৈরি করতে পারলে ওষুধশিল্প আরও সমৃদ্ধ হবে। এমনকি উৎপাদিত কাঁচামাল বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব।
দেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে বিশ্ববাণিজ্যে জিএসপি, ছাড়সহ আমাদের কয়েকটি সুবিধা প্রত্যাহƒত হবে; তখন প্রতিযোগীদের সঙ্গে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। ওই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের অন্যতম সম্ভাবনাময় পণ্য হওয়ার কথা ওষুধশিল্প। সে জন্য ওষুধের বিশ্ববাজার ধরতে বড় উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। বৈশ্বিক ওষুধ বাজারে আমাদের অবস্থান দৃঢ় করতে হলে এ খাতের প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ দিতে হবে। ওষুধের রপ্তানি বাজার প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের। এর ৫ শতাংশও অর্জন সম্ভব হলে রপ্তানি আয় হবে ১০ বিলিয়ন ডলার। ডলার সংকট নিরসন, কাঁচামাল আমদানি, কর অবকাশসহ দরকারি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে, ওষুধের সুনাম ও সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে কম সময়ের মধ্যেই এ বাজার ধরা সম্ভব। অবশ্য কাঁচামাল আমদানির ফলে দেশে তৈরি ওষুধের দাম তুলনামূলক বেড়ে যায়। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় এপিআই শিল্প পার্কে পুরোদমে উৎপাদন শুরু করলে ওষুধশিল্পে কাঁচামালের চাহিদার সিংহভাগই জোগান দেয়া সম্ভব হবে। এ ধারায় বাণিজ্যিক উৎপাদন পুরো শুরু হলে ওষুধের দামও কমবে। অপেক্ষাকৃত কম দামে রপ্তানি করা যাবে। সে ক্ষেত্রে ওষুধ রপ্তানি করে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, দুর্যোগকালে ওষুধসামগ্রী দিয়ে বন্ধুদেশের পাশে দাঁড়ানো এবং দেশবাসীর জন্য কমদামে মানসম্পন্ন ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারব। তাই ওষুধশিল্পের স্বনির্ভরতা অর্জনে সর্বাত্মক উদ্যাগ নিতে হবে।