শেয়ার বিজ ডেস্ক: কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডীর চাষি শাহজাহান মনির (৪৩) গত বছর লাভবান হয়ে এবার ৯ কানি (৪০ শতকে কানি) জমিতে লবণ চাষ করছেন। গত মৌসুমে তিনি চাষ করেছিলেন ৬ কানিতে। এবার মৌসুমের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় লবণের উৎপাদন ভালোই হচ্ছে। গত সোমবার পর্যন্ত ৯ কানিতে প্রায় এক হাজার মণ লবণ উৎপাদন হয়েছে।
উৎপাদন ভালো হলেও লবণ নিয়ে চরম হতাশ তিনি। কারণ উৎপাদন খরচের চেয়ে ১৫০-১৬০ টাকা কম দামে লবণ বিক্রি হচ্ছে। গত এক সপ্তাহ ধরে মাঠে লবণ বিক্রি হচ্ছে ৩২০-৩২৫ টাকা মণ। পরিবহন ও মধ্যস্বত্বভোগী মিলে মণে আরও খরচ পড়ে ১০০ থেকে ১১০ টাকা। অথচ এক মণ লবণ উৎপাদনে খরচ পড়ছে ৩৬০-৩৮০ টাকা। যেখানে প্যাকেটজাত লবণ ৪০-৪৫ টাকা কেজি কিনতে হয়, সেখানে মাঠে উৎপাদিত লবণ বিক্রি করে কেজিপ্রতি দাম মিলছে ৬ টাকা। ফলে এবার বাড়তি দামে জমি লিজ নেওয়া, লেবার ও অন্যান্য খরচ ওঠাতো দূরে থাক, উল্টো ধার-দেনায় শ্রমিক বিদায় করতে হবে বলে মনে করছেন শাহজাহান।
শুধু তিনি নন, এই একই চিত্র ঈদগাঁওয়ের পোকখালী, গোমাতলী, চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, বাঁশখালী, আনোয়ারা, টেকনাফ, সদরের ভারুয়াখালী, খুরুশকুল এলাকায় মাঠে থাকা সব লবণচাষির। ঈদগাঁওয়ের গোমাতলীর লবণচাষি রিদুয়ানুল হক বলেন, চলতি মৌসুমের শুরু থেকেই লবণের দাম গত মৌসুমের চেয়ে কম। এর ধারাবাহিকতা এখনো বিদ্যমান। এক মণ লবণ বিক্রি করে ২২০টাকা পেতে কষ্ট হচ্ছে। এতে প্রতি মণ লবণের বিপরীতে চাষিদের ১৬০ হতে ১৮০ টাকার মতো লোকসান হচ্ছে। প্রতি মণ লবণ উৎপাদনে খরচ পড়ছে প্রায় ৩৬০-৩৮০টাকা। এ অবস্থা শেষ পর্যন্ত চলতে থাকলে চাষিদের পথে বসতে হবে।
লবণের দাম কমার বিষয়ে আরেক চাষি সাইফ উদ্দিন বলেন, মিল মালিকরা সিন্ডিকেট করে লবণের দাম কমিয়ে দিয়েছেন। সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে লবণ বিক্রির সুযোগ নেই। উৎপাদিত লবণ পোকখালী ও গোমাতলী থেকে নদীপথে কার্গো বোটে ইসলামপুর লবণ শিল্পাঞ্চলে পাঠানো হয়। চলতি মৌসুমে যারা ১০ কানি মাঠে চাষ করছেন তাদের মৌসুম শেষে ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হবে। এখন পর্যন্ত কানিতে ১০০ থেকে ১১০ মণ লবণ উৎপাদন হয়েছে পোকখালী-গোমাতলী-চৌফলদন্ডী ও আশপাশের মাঠ এলাকায়। এসব এলাকায় ৬ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে কক্সবাজার জেলা সদর, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া, ঈদগাঁও, টেকনাফ এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও আনোয়ারা এবং পটিয়া উপজেলার কিছু অংশে সাড়ে ৬৮ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে। গত ১ মার্চ পর্যন্ত উৎপাদিত হয়েছে ৬ লাখ ৩২ হাজার মেট্রিক টন লবণ। এবার লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। দেশে লবণের বার্ষিক চাহিদাও ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। মাঠ পর্যায়ে উৎপাদিত লবণ বিক্রি হচ্ছে গড়ে ২২৫ টাকায়।
চাষিদের অভিযোগ, সিন্ডিকেট করেই লবণের দাম কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে চাষিরা লবণ উৎপাদন বন্ধ রাখেন। এমনটি হলে দেশে লবণের সংকট সৃষ্টি হলে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করা যাবে। এটা হলে দেশের স্বয়ংসম্পূর্ণ লবণ শিল্পকে ধ্বংস করার সামিল হবে এটি। আবার সঠিক মূল্য না পেয়ে সরকারিভাবে লবণ সংরক্ষণ করার কোনো গুদাম নেই। পুরোনো নিয়মে আমরা গর্তেই তা সংরক্ষণ করছি। ভবিষ্যতে দাম বাড়লে গর্ত থেকে তুলে সেই লবণ বিক্রি হবে।
মহেশখালী লবণচাষি ঐক্য সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি শাহাব উদ্দিন বলেন, লবণের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে বহু চাষি হতাশ হয়ে পড়েছেন। অনেকে লবণ উৎপাদন বন্ধ করে দিচ্ছেন। যারা উৎপাদন অব্যাহত রাখছেন তারা গর্তে জমিয়ে ফেলছেন লবণ।
বিসিকের লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, লোকসানেই লবণ বেচাবিক্রি করতে হচ্ছে চাষিদের। এতে চরম হতাশ হয়ে অনেক চাষি উৎপাদন বন্ধ রাখছেন। আবার নিরুপায় হয়ে অনেকে উৎপাদন অব্যাহত রেখেছেন। তবে অধিকাংশ চাষিই লবণ বিক্রি না করে গর্তে সংরক্ষণ করছেন। টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, ঈদগাঁও, চকরিয়াতে অন্তত কয়েক হাজার গর্তে বর্তমানে লাখো মেট্রিক টন লবণ মজুত রয়েছে। আকারভেদে প্রতিটি গর্তে লবণ রাখা যায় ২০০ থেকে এক হাজার মণ পর্যন্ত।
ইদ্রিস আলীর মতে, গুদামে লবণ মজুত করলে তা শুকিয়ে ওজনও কমে যায়। গর্তে রাখলে শুকিয়ে যায় না। বরং নিরাপদে থাকে। ঝড়বৃষ্টি কিংবা জলাবদ্ধতাতেও গর্তের লবণ নষ্ট হয় না। গর্তের ভেতরে এসব লবণ পলিথিন মোড়ানো থাকে। গর্তের মুখও মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়।
আন্দোলনকারীদের দাবি, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম দেশের একমাত্র দেশীয় লবণ উৎপাদন কেন্দ্র। চাহিদার প্রায় ৯৫ শতাংশ লবণ উৎপাদন হয় কক্সবাজারের টেকনাফ, কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া উপজেলায় এবং অবশিষ্ট ৫ শতাংশ লবণ উৎপাদন হয় চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও পটিয়ায়। গত মৌসুমে প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুকূলে থাকায় উৎপাদিত লবণ চাহিদা মিটিয়ে দুই লাখ ২২ হাজার মেট্রিক টন লবণ মজুদ ছিল। চলতি মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় উৎপাদন প্রক্রিয়া ভালোভাবেই চলছে। প্রায় ৬৮ হাজার একর জমিতে দেশীয় লবণ শিল্পের উৎপাদনে ৬৫ হাজার চাষিসহ ১০ লাখ মানুষের আয়ব্যয় সক্রিয়।
বিসিক কক্সবাজার লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, লবণের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় আবহাওয়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকার পরও চাষিরা লবণ উৎপাদনে অনীহা প্রকাশ করছেন। লবণের দাম কেন কমে গেলো তার কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে।