কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দেশের অর্থনীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক : বৈশ্বিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, রপ্তানি সংকট এবং জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতার জোড়া চাপে বাংলাদেশের অর্থনীতি সামনে এক কঠিন সময় পার করতে যাচ্ছে—এমনটিই উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) সর্বশেষ মূল্যায়নে।

আইএমএফের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির ঋণ ছাড়ের অংশ হিসেবে প্রকাশিত বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) রাতে প্রকাশিত বিস্তারিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ভবিষ্যৎ ঝুঁকি, সম্ভাবনা এবং নীতিগত সংস্কার পরিকল্পনার সুপারিশ দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিকভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আবার বেড়ে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। এতে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয়ও বাড়বে। তখন দেশটি বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতির ওপর চাপ পড়বে। চলতি অর্থবছরে দেশের বৈদেশিক লেনদেনের স্থিতির ঘাটতি জিডিপির হারে কমলেও আগামী বছরগুলোতে তা বেড়ে যেতে পারে। চলতি অর্থবছরে এ খাতে ঘাটতি জিডিপির সাড়ে ৩ শতাংশের মধ্যে নেমে আসতে পারে। কিন্তু আগামী বছরগুলোতে এ ঘাটতি ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করেছে আইএমএফ। এতে ডলার বাজারের ওপর চাপ বাড়বে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বেশ ভালোভাবেই প্রভাবিত করে। কারণ দেশটির রেমিট্যান্সের বড় অংশই আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। এসব দেশে অস্থিরতা তৈরি হলে রেমিট্যান্স প্রবাহেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সংকটের কারণে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কারণ জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো ঝুঁকিতে রয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানির অভাবে দেশের বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বা বিশেষ করে উৎপাদন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানির ওপর ট্রাস্প প্রশাসন যে বাড়তি শুল্ক আরোপ করেছে তাতে পোশাক রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এতে দেশের অর্থনীতিতে চাপ বাড়বে। কারণ রপ্তানির আয়ের প্রায় ৮৬ শতাংশই তৈরি পোশাক খাত থেকে আসে। তৈরি পোশাকের ৫৪ শতাংশই রপ্তানি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে।

রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে ক্ষতের মধ্যে পড়েছে তা এখনো সেরে উঠতে পারেনি। এর মধ্যে এসব সংকট দেখা দিলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এসব সংকট মোকাবেলার জন্য আইএমএফ বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করার সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি এ খাতে ভর্তুকি কমিয়ে বাজেটের ওপর চাপ কমানোর কথা বলেছে। জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত হলে উৎপাদন খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থার সঞ্চার হবে। তখন তারা বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। এতে অর্থনীতি চাঙ্গা হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক বিষয়ে একটি সন্তোষজনক সমাধানের কথা বলা হয়েছে; যাতে পোশাক রপ্তানি বাধাগ্রস্ত না হয়। পাশাপাশি রপ্তানির ক্ষেত্রে একক পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বহুমুখী করার সুপারিশ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে আমদানি পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমাতে দেশে কৃষিপণ্যের ওপর উৎপাদন বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে সরকারের সংস্কার কার্যক্রমে বিভিন্ন খাতে লক্ষ্য অর্জনের সময় সীমাও বেঁধে দিয়েছে। এর মধ্যে চলতি জুনের মধ্যে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ব্যাপকভাবে সংস্কার করতে হবে। এ বিষয়ে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। করদাতাদের হয়রানি কমাতে ই-রিটার্ন পদ্ধতি চালু করতে হবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে করদাতাদের উন্নত সেবা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে এনবিআরকে। সব ধরনের কর ছাড় বন্ধ করতে হবে আগামী বছরের মার্চের মধ্যে। চলতি জুনের মধ্যে সরকারি লেনদেনের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ অনলাইনে করতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়দেনা নিশ্চিত করতে তা পরিশোধ করতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের ঋণকে বেসরকারি খাতের মতো করে শ্রেণিবিন্যাসিত করতে হবে। এটি বাস্তবায়ন করতে হবে চলতি মাস জুনের মধ্যে।

জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে তিন বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি এ খাতে দেওয়া ভর্তুকি শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। বিনিময় হারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এককভাবে বাংলাদেশ ব্যাংককে দিতে হবে। এ খাতে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো হস্তক্ষেপ করা যাবে না।

আগামী বছরের জানুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে মুদ্রানীতি প্রণয়নের ও বাস্তবায়নের পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।