টেন্ডারার্স ফাইন্যান্সিংয়ে রেলের ২০০ কোচ ক্রয়

কঠিন শর্তের ৮০৭ কোটি টাকার ঋণপ্রস্তাব বাতিল অর্থ মন্ত্রণালয়ে

ইসমাইল আলী: কঠিন শর্তের ঋণে (টেন্ডারার্স ফাইন্যান্সিং) ২০০টি মিটারগেজ কোচ কেনায় ২০১১ সালে উদ্যোগ নেয় রেলওয়ে। তবে প্রকল্প অনুমোদনের আগেই আহ্বান করা হয় দরপত্র। এতে কাজ পায় চীনের নামসর্বস্ব সিআরআরসি সিফ্যান কোম্পানি লিমিটেড। আর ২০১৬ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়। কোচগুলো কেনায় ঋণ দেয়ার কথা ছিল ফ্রান্সের একটি ব্যাংকের। তবে কঠিন শর্তের সে ঋণপ্রস্তাব সম্প্রতি বাতিল করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে বাতিল করতে হচ্ছে ২০০ কোচ কেনার চুক্তিও।

এদিকে কোচগুলো কেনায় সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। এ নিয়ে গত বছর অসন্তোষ প্রকাশ করে পরিকল্পনা কমিশন। নামসর্বস্ব চীনা কোম্পানিটির সক্ষমতা নিয়ে এর আগে প্রশ্ন তুলেছিল অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগও (ইআরডি)। এজন্য কোম্পানিটির সক্ষমতা যাচাইয়ের সুপারিশ করা হয়েছিল। যদিও করোনার কারণে তা করা সম্ভব হয়নি।

তথ্যমতে, ২০০ মিটারগেজ কোচ কেনায় ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৯২৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এর মধ্যে আট কোটি ৪৯ লাখ ৭০ হাজার ডলার ঋণ দেয়ার কথা ছিল ক্রেডিট এগ্রিকোল করপোরেট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ফ্রান্সের। বর্তমান ব্যাংক বিনিময় হার ধরলে (এক ডলার = ৯৫ টাকা) এর পরিমাণ ৮০৭ কোটি ২২ লাখ টাকা।

এ ঋণের সুদহার ধরা হয়েছিল ছয় মাস মেয়াদি ইউরো আন্তঃব্যাংক অফার রেটের (ইউরিবর) সঙ্গে দুই শতাংশ যোগ করে নির্ধারিত হার (ইউরিবর+২%)। পাশাপাশি প্রতি বছর ছাড় না হওয়ার ঋণের ২৫ শতাংশ কমিটমেন্ট ফি দিতে হবে। এছাড়া অ্যারেঞ্জমেন্ট ফি দিতে হবে মোট ঋণের ১ দশমিক ৩ শতাংশ। আর ১৫ বছর মেয়াদি ঋণের গ্রেস পিরিয়ড ধরা হয়েছে তিন বছর।

ঋণপ্রস্তাব নিয়ে দরকষাকষি শেষে ২০১৯ সালের ১৯ জুলাই ক্রেডিট এগ্রিকোল করপোরেট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ফ্রান্সকে চিঠি দেয় ইআরডি। আর ২০ সেপ্টেম্বরে প্রস্তাবটি পাঠানো হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনমনীয় ঋণবিষয়ক স্থায়ী কমিটিতে। ওই বছর ১৮ অক্টোবর প্রস্তাবটি নিয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়। তবে কমিটি ওই ঋণপ্রস্তাব অনুমোদনের আগে দুটি শর্ত দেয়।

শর্ত দুটি হলোÑপ্রথমত, ঋণচুক্তি সইয়ের আগে সরবরাহকারী কোম্পানির মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন সক্ষমতা যাচাই করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান যেসব দেশে যাত্রীবাহী কোচ সরবরাহ করেছে, সেসব দেশে একটি প্রতিনিধিদল পাঠাতে হবে। তারা কোম্পানিটির সরবরাহকৃত কোচের গুণগত মান ও কর্মদক্ষতা যাচাই করবে। পাশাপাশি কোম্পানিটির সক্ষমতাও যাচাই করবে। রেলপথ মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।

যদিও করোনার জন্য চীনে বা সরবরাহকারী কোম্পানির পণ্য আমদানিকারক কোনো দেশেই প্রতিনিধিদল পাঠাতে পারেনি রেলপথ মন্ত্রণালয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে কোচগুলো কেনার শর্ত পরিবর্তনের জন্য গত মার্চে ইআরডিতে চিঠি পাঠানো হয়। পরে ইআরডি ওই প্রস্তাব অনমনীয় ঋণবিষয়ক স্থায়ী কমিটিতে পাঠায়। গত ২ আগস্ট ওই কমিটিতে ঋণপ্রস্তাব নিয়ে আবার সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ঋণপ্রস্তাবটি বাতিল করা হয়। পাশাপাশি চীনের সিআরআরসি সিফ্যান কোম্পানির সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তিও বাতিলের সিদ্ধান্ত দেয়া হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ আগস্ট রেলপথ মন্ত্রণালয়ে প্রকল্পটি স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সিআরআরসি সিফ্যান কোম্পানির সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি বাতিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে নির্দেশনা দেয়া হয়। বৈঠকে জানানো হয়, বাণিজ্যিক চুক্তি বাতিলের ক্ষেত্রে চুক্তিতে তিনটি অপশন রয়েছে। তবে সরাসরি ঋণপ্রস্তাব বাতিলের পরিপ্রেক্ষিতে চুক্তি বাতিল করা হলে কোম্পানিটি পারফরম্যান্স গ্যারান্টির (পিজি) বিপরীতে সুদ দাবি করতে পারে। তাই অপর দুটি অপশন বিবেচনা করে চুক্তি বাতিলের বিষয়টি সিআরআরসি সিফ্যান কোম্পানিকে জানানোর সিদ্ধান্ত দেয়া হয়।

বৈঠকের তথ্যমতে, ২০০ মিটারগেজ কোচ কেনায় সিআরআরসি সিফ্যান কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সই হয় ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর। চুক্তিমূল্য ছিল আট কোটি ৪৯ লাখ ৭০ হাজার ডলার। এর বিপরীতে ৮০ লাখ ৫০ হাজার ডলার পিজি জমা দেয় কোম্পানিটি, যার মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের ৩০ জুন। তার আগেই চুক্তি বাতিল করে পিজি ফেরত দিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে বৈঠকে উপস্থিত রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে জানান, চুক্তি বাতিল করাটা জরুরি হয়ে পড়েছিল। কারণ ২০১৮ সালে যখন কোচগুলো কেনায় চুক্তি করা হয়, তখন ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮০ টাকার মতো। বর্তমানে তা ৯৫ টাকা ছাড়িয়ে গেছে (অফিশিয়াল রেট)। এতে কোচগুলো কেনার ব্যয় অনেক বেড়ে যেত। এছাড়া কোম্পানিটির অস্তিত্ব অনলাইনে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই অনমনীয় ঋণবিষয়ক স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে করণীয় নির্ধারণে সভায় সুপারিশ করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, টেন্ডারার্স ফাইন্যান্সিংয়ের আওতায় ২০০ মিটারগেজ কোচ কেনায় রেলওয়েকে ২০১১ সালের ২০ জুলাই বিশেষ অনুমোদন দেয় অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। আর ২০১২ সালের ৯ এপ্রিল কোচগুলো কেনায় অগ্রিম ক্রয় প্রক্রিয়াকরণ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নীতিগত অনুমোদন নেয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সে বছর ৪ অক্টোবর প্রকল্পটির দরপত্র আহ্বান করা হয়।

২০১৬ সালের ৪ অক্টোবর প্রকল্পটি একনেকে (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) অনুমোদন করা হয়। আর ২০১৭ সালের ১১ অক্টোবর সিসিজিপি (সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি) ২০০ কোচ ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন করে। যদিও ২০১৮ সালের চুক্তি সইয়ের পর ১৩ ডিসেম্বর সরবরাহকারী কোম্পানির নাম নিয়ে আপত্তি তোলে সিপিটিইউ (সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট ইউনিট)। তবে অনির্দিষ্ট কারণে চুক্তিটি বাতিল হয়নি। অবশেষে সিআরআরসি সিফ্যান কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি বাতিল হতে যাচ্ছে।