Print Date & Time : 16 August 2025 Saturday 5:59 am

কত বড় আর বর্ণাঢ্যই না হতো আমাদের শেয়ারবাজারটি!

ড. আর এম দেবনাথ: শেয়ারবাজার নিয়ে লেখালেখির কোনো অভাব নেই। অর্থনৈতিক দৈনিকগুলো নিয়মিত এ বাজারের ওপর আলোকপাত করে যাচ্ছে। এছাড়া রয়েছে দৈনিক পত্রিকা ও টেলিভিশন। কত বিচিত্র সব ‘স্টোরি’! পড়লে পরিষ্কার বোঝা যায়, ছোট্ট একটা বাজার; কিন্তু তার সমস্যার অভাব নেই। বাজার ছোট কেন? এর কারণ অনেক। বড় কারণ অবশ্যই শেয়ারের অভাব, ভালো শেয়ারের অভাব। বাজার বড় হবে কীভাবে? যারা ব্যবসা করছে চুটিয়ে, তারা শেয়ারবাজারে নাম লেখাতে রাজি নয়, ওই বাজারে তালিকাভুক্ত (লিস্টেড) হতে রাজি নয়। বেসরকারি কোম্পানির কথা বুঝলাম, না হয় বুঝলাম বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কথাও। কিন্তু সরকারি কোম্পানি বাজারে না আসার কারণ কী? সরকার ব্যবসা করবে না বলে অঙ্গীকারবদ্ধ। সরকার বাজার অর্থনীতির সরকার। সব এখন খোলামেলা। আমদানি-রফতানি ব্যবসা খোলা। লাইসেন্স-পারমিটের ঝামেলা নেই বললেই চলে। ব্যাংকের ব্যবসা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ১৯৮৩-৮৪ সালের দিকে। প্রায় ৮০ শতাংশ ব্যাংক ব্যবসা এখন বেসরকারি ব্যাংকের হাতে। যে কয়টা সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক আছে, সেগুলোকেও পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি করা হয়েছে এক দশকেরও আগে। উদ্দেশ্যÑএদের বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া। উদ্দেশ্য এদের শেয়ারবাজারে ছেড়ে দেওয়া। সরকারের বহু ব্যবসায়িক সংস্থাকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়েছে অনেক আগে। তা-ই তো হবে। কারণ আমরা বাজার অর্থনীতির দেশ। বাজার অর্থনীতির দেশ বললে ভুল হবে। অবাধ বাজার অর্থনীতির দেশ। তাহলে প্রশ্ন, বিরাট প্রশ্ন, সরকার কেন ওইসব সরকারি কোম্পানির শেয়ার বাজারে ছাড়ছে না? এখানে তো কেউ বাধা দেওয়ার নেই। মালিক স্বয়ং সরকার। তাহলে কেন তা হচ্ছে না? অথচ সরকার মুখে মুখে বলছে, তারা শেয়ারবাজার চায়। এ বাজারের উন্নতি হোক সরকার প্রায়ই এ কথা বলছে। তবে কেন সরকার তার নিজস্ব কোম্পানির শেয়ার বাজারে ছাড়ছে না?

কাগজে আশ্চর্য এক স্টোরি পড়লাম (২১ মার্চ ২০১৭)। সরকার চাইছে শেয়ার বিক্রি করতে। এ উদ্দেশ্যে ২৬টি কোম্পানির নামও ঠিক করা হয়েছে। এটা বহুদিন আগের কথা। কিন্তু নানা অজুহাতে কোম্পানিগুলোর প্রশাসন প্রক্রিয়াটিকে বন্ধ করে রেখেছে। ওজর-আপত্তির শেষ নেই। কুযুক্তিরও শেষ নেই। তাগিদের পর তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কোম্পানি প্রশাসন সরকারের কথা শুনছে না। স্টোরিটিতে এ কথাই বলা হয়েছে। বড়ই উদ্বেগের খবর, দুশ্চিন্তার খবর। কারণ সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে প্রশাসন। তার মানে কী? প্রশাসন অধিকতর ক্ষমতাশালী, সরকার দুর্বল। অথবা সরকার আধাআধি কথা বলছে। সরকারের যারা নীতিনির্ধারণে জড়িতÑতারা কাগজপত্রে, মুখে বলছে এক কথা, মনে আরেক। কোনটা সত্য ধরে নেব? সাধারণভাবে দেখা যায়, আমলারা ক্ষমতা ছাড়তে চান না। অর্থনৈতিক ক্ষমতা যেমন ছাড়তে চান না, তেমনি ছাড়তে চান না প্রশাসনিক ক্ষমতা। এর মোক্ষম উদাহরণ বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনি ক্ষমতা ও অধিকার প্রশাসনিক অর্ডারে ছিনিয়ে নিয়েছে ব্যাংকিং বিভাগ। এ বিভাগ সরকারি ব্যাংকের বোর্ডের ক্ষমতাও ছিনিয়ে নিয়েছে। এখন সরকারি ব্যাংকের বোর্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথ। তারা সারাদিন ‘মিডিয়া’র গাল খায়। এমন একটা অবস্থা দেখা যাচ্ছে শেয়ার অফলোডিংয়ের ক্ষেত্রে। এছাড়া সরকারি সিদ্ধান্ত কার্যকর না হওয়ার কারণ কী হতে পারে? হতে পারে সরকারের দুর্বলতা। সরকার আমলাদের ক্ষেপাতে চায় না। কিসের শেয়ারবাজার? এছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে? সরকার যদি দুর্বল হয় অথবা তোয়াজে ব্যস্ত থাকে তার সুবিধা শুধু প্রশাসন নেয় না, নেয় বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরাও। এক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে একই চিত্র। দেশে লক্ষাধিক প্রাইভেট কোম্পানি আছে, আছে পার্টনারশিপ ব্যবসা। এর মধ্যে কম করে হলেও দশ-বিশ-ত্রিশ শতাংশ কোম্পানি চুটিয়ে ব্যবসা করছে। হাজার হাজার কোটি টাকা অনেক কোম্পানির বেচাকেনা। তাদের আমদানি ও রফতানি ব্যবসার তথ্য নিলে দেখা যাবে, অনেক বহুজাতিক কোম্পানিও তাদের সঙ্গে পারবে না প্রতিযোগিতা করতে। তারা শত শত, হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে ব্যাংক থেকে। ব্যাংকগুলো তাদের পেছনে পেছনে ঘোরে। তাদের ‘কোলেটারেল’ দিতে হয় না। অনেক শর্ত তাদের জন্য শিথিল। তারা খেলাপি যাতে না হয়, তার জন্য ঋণ পুনঃকাঠামো পর্যন্ত করা হচ্ছে। অথচ এসব কোম্পানির ‘ব্যালান্স শিট’ হাস্যকর। পরিশোধিত মূলধন যৎসামান্য। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-ভ্রাতারাই কোম্পানি চালাচ্ছেন বেনামে। এসব কোম্পানিও শেয়ারবাজারে আসছে না। তাদেরও ওজর-আপত্তির অভাব নেই। এই নেই, ওই নেই শেয়ারবাজারে! কেন মুনাফা ভাগ করে খাব সাধারণ লোকের সঙ্গে! অথচ কোম্পানিগুলো ‘পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি’ হয়ে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলে সরকার কর সুবিধা দেয়। এই সুযোগ-সুবিধা অনেক দিন থেকে চালু। অথচ তারা শেয়ারবাজারে আসছে না। অর্থমন্ত্রী বার বার তাদের আহ্বান জানাচ্ছেন। বলছেন তাদের শেয়ারবাজারে আসতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা!

সহজে দেশি-বিদেশি ব্যাংক ঋণ পেতে পেতে তারা এখন আর শেয়ারবাজারে যেতে চায় না। জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার মধ্যে আসতে চায় না তারা। উল্টো বরং ইদানীং বড় ব্যবসায়ীরা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন বিদেশে বিনিয়োগ করার সুযোগ দেওয়ার জন্য। তারা সিঙ্গাপুর, হংকং, মালয়েশিয়া, দুবাই, আফ্রিকায় বিনিয়োগ করতে চায়। বাজারে খবর, তাদের অনেকেরই বিদেশে বিনিয়োগ আছে। অবশ্যই তা অনুমোদিত বিনিয়োগ নয়। কারণ বিদেশে বিনিয়োগের জন্য ডলার নেওয়া নিষিদ্ধ। অথচ এর জন্যই তারা এখন চাপ দিচ্ছে সরকারের ওপর। চাপটা আসছে এমনসব ব্যবসায়ীর পক্ষ থেকে, যাদের বাজারে আবার ‘সুনাম’ আছে। বুঝি না, ব্যবসায়ীরা বিদেশে যেতে চান, সেখানে বিনিয়োগ করতে চান; অথচ দেশের শেয়ারবাজারে যোগদান করে ব্যবসা বড় করতে চান না। তবে কি দেশে ব্যবসার কোনো সুযোগ নেই, তবে কি ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ নেই? তা কীভাবে হয়? সরকার বার বার বলছে, বিনিয়োগের শতভাগ অনুকূল পরিবেশ বিরাজমান। আমরা কোনটা বিশ্বাস করবো? সরকারকে, না ব্যবসায়ীদের? তবে একটা জিনিস পরিষ্কার, এরা নানা অজুহাতে শেয়ারবাজারে আসছে না। অথচ এলে কী বিশাল একটা শেয়ারবাজার হতো! বর্তমানে ঢাকা শেয়ারবাজারে প্রায় ৩০০টি কোম্পানি আছে বলে খবরের কাগজে দেখছি। এ ৩০০টির মধ্যে কয়টা ভালো কোম্পানি, তা সবাই জানে। এই কয়টা কোম্পানির শেয়ার নিয়েই আমরা কত গর্ব করছি, স্টোরি লিখছি। দিনের পর দিন পাতা ভরছি। অথচ সরকারি ও বেসরকারি খাতের আরও ৩০০ কোম্পানি বাজারে এলে কী অবস্থা দাঁড়াতো? অর্থনৈতিক রিপোর্টার, শেয়ার রিপোর্টারদের ইজ্জত কত বাড়তো! বিদেশে আমাদের কদরও বাড়তো।

আমার ধারণা, যেহেতু সরকারি কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসছে না এবং যেহেতু দেশি কোম্পানিগুলোও বাজারে আসছে না, সেহেতু সুযোগ বুঝে বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও শেয়ারবাজারমুখী হচ্ছে না। অথচ এরা এলে কী দারুণ ব্যাপার হতো! এক গ্রামীণফোনের শেয়ারই বাজার মাত করে রেখেছে। ১০-১২টি বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার বাজারে চালু। কী কদর তাদের! হবে না কেন? ওরা চুটিয়ে ব্যবসা করছে। বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিচ্ছে। ছল-চাতুরি নেই, তা বলবো না। তবু তারা ভালো লভ্যাংশ দিচ্ছে। এ অবস্থায় যদি বাকি বহুজাতিক কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে আসতো, তাহলে বাজারের আকার বিশাল হতো। বেচাকেনা বহুগুণ বাড়তো। বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিত হতেন। তারা শেয়ার ট্রেডার না হয়ে সত্যি সত্যি ‘ইনভেস্টর’ হতেন। জানি না কতটি বিদেশি কোম্পানি দেশে ব্যবসা করছে। একটি কাগজে দেখলাম, ৪০টির উপরে রয়েছে বিদেশি কোম্পানি। সংখ্যায় খুবই কম; কিন্তু গুণে বহু। এরা শেয়ারবাজারে এলে ব্যাপারটাই আলাদা হতো। অথচ তারা আসছে না।

এ দুরবস্থার জন্য কে দায়ী? সরকার দায়ী? ব্যবসায়ীরা দায়ী? বিনিয়োগকারীরা দায়ী? বিদেশি কোম্পানিগুলো দায়ী? নাকি দায়ী মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো? অলিগলিতে মার্চেন্ট ব্যাংক।

শেয়ারবাজারের উল্লম্ফনে এবং তদ্ভূত উত্তেজনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডজন ডজন মার্চেন্ট ব্যাংকের অনুমতি দেয়। শুনেছি, সব সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকেরই মার্চেন্ট ব্যাংক আছে। মার্চেন্ট ব্যাংক ‘মার্চেন্ট’ও নয়, ব্যাংকও নয়। এরা শেয়ারবাজারের ব্যবসায়ী। বিনিয়োগে সহায়তা করে। এরা কী করছে? কী করছে সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)? বেতন-ভাতা, গাড়ি-বাড়ি ভোগ করা, সরকারি দাওয়াত খাওয়া, বিদেশ ভ্রমণই তাদের একমাত্র কাজ? এদের কি কোনো জবাবদিহিতা (অ্যাকাউন্ট্যাবিলিটি) নেই? জবাবদিহিতা নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের? জবাবদিহিতা নেই মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর? দেশে কি ‘ফ্রি ফর অল’ চালু থাকবে? বেসরকারি খাত কি ব্যাংকঋণেই চলবে? তাদের কি শেয়ারবাজারে আনার কোনো উপায় নেই? সরকারি প্রশাসনকে শাসিয়ে কি সরকারের কোম্পানিগুলোকে কোনোমতেই শেয়ারবাজারে আনার উপায় নেই? হতাশাজনক এক পরিস্থিতি। গার্জিয়ানহীন একটি বাজার। আসুন, সবাই এর জন্য প্রার্থনা করি।

অর্থনীতি বিষয়ের কলামিস্ট
সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়