বাল্যবিয়ের মাধ্যমে এমন দুটি অপরিপক্ব আত্মাকে একত্র করা হচ্ছে, যারা জীবনের বাস্তবতাই জানে না। বর্তমান বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যার অন্যতম হচ্ছে বাল্যবিয়ে। বাংলাদেশ বিবাহ আইনে মেয়েদের ন্যূনতম ১৮ এবং ছেলেদের ২১ বছর বিয়ের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বিশেষ প্রয়োজনে, যথাযথ প্রমাণ সাপেক্ষে মেয়েদের ১৬ এবং ছেলেদের ১৮ বছর বয়সে বিয়ে দেয়ার অনুমতি আছে। ১৮ বছরের নিচে কোনো কিশোর-কিশোরীকে বিয়ে দেয়া হলে সেটা বাল্যবিয়ে বলে গণ্য করা হয়।
দারিদ্র্য, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রথা, মেয়েদের উপার্জনে অক্ষম ভাবা, অবিবাহিত থাকার ভয়, অসচেতনতা-সহ নানা বিষয় বাল্যবিয়ের কারণ বলে উল্লেখ করে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এর বাইরে নতুন প্রভাবক হিসেবে যোগ হয়েছে কভিড মহামারি। এ প্রভাবক সম্পর্কে আমরা কতটুকু সচেতন হতে পেরেছি? ইউনিসেফের এক জরিপে উঠে এসেছে, ২০২০ সালের মহামারির পর থেকে এ পর্যন্ত কিশোরীদের বিয়ের হার বেড়েছে ১৩ দশমিক পাঁচ শতাংশ। পাশাপাশি আগামী দুই বছরে অন্তত ৪০ লাখ মেয়েশিশু বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে রয়েছে, যা সত্যিই আমাদের সবার জন্য বেদনার। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে ১৫-১৮ বছর বয়সী কিশোরীদের বিয়ের হার ছিল ৫১ দশমিক চার শতাংশ, যা এ মহামারিতে হয়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫ দশমিক তিন শতাংশ। এর পেছনে মহামারি-সম্পর্কিত নানা কারণ, যেমন স্কুল বন্ধ থাকা, দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়াসহ নানা বিষয় জড়িত বলে উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাল্যবিয়ের ফলে একটি অপরিণত ও বাড়ন্ত কিশোরীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিনোদনের মতো মৌলিক অধিকার বন্ধ হয়ে যায়, বন্ধ হয়ে যায় সামাজিকীকরণের স্বাভাবিক বিকাশ। অনেকেই নতুন পরিবারে, নতুন পরিবেশে নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্রকাশে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা পূরণের বয়সে এবং নিজেকে বিকশিত করার বয়সে তারা একপ্রকার শিকলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। মেয়েদের কাছে যথাযথ প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা না পৌঁছানোর দরুন অনেকে সন্তান গর্ভধারণের মতো ঝুঁকি নিয়ে থাকে। ফলে পুষ্টিহীনতা ও রক্তশূন্যতার মতো সমস্যাও দেখা দেয়। অপরিণত বয়সে গর্ভধারণের ফলে পুষ্টিহীন শরীরে অপুষ্টিগত অভিশাপের বোঝা নিয়ে বেড়ে ওঠে আরেকটি অনাগত ভবিষ্যৎ। জন্ম নেয় আরেকটি অপুষ্টিতে আক্রান্ত প্রজন্ম। বেড়ে যায় মা ও শিশুর মৃত্যুর ঝুঁকি। এক জরিপে উঠে এসেছে শারীরিক অক্ষমতার কারণে মা হতে গিয়ে রক্তশূন্যতাসহ নানা রোগে মারা যাচ্ছে প্রতি ২০ মিনিটে একজন। পাশাপাশি প্রতি ঘণ্টায় একটি নবজাতকের মৃত্যু হচ্ছে।
কভিড মহামারির কারণে বেড়েছে আর্থিক অসচ্ছলতা। বিভিন্ন জরিপ অনুযায়ী দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোয় দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। আর এ দারিদ্র্য সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে কিশোরীদের জীবনে। দারিদ্র্য ও সামাজিক অনিরাপত্তার কারণে অপরিণত ও বাড়ন্ত মেয়েটাকে বিয়ে দিতে অভিভাবকদের কুণ্ঠাবোধ না করারই কথা! তাই আমাদের এ অসচেতনতার ব্যর্থতা স্বীকার করে আরও সচেতন হতে হবে। ক্যাম্পেইন ও টিভি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সবাইকে সচেতন করতে হবে। বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে অভিভাবকদের বাল্যবিয়ে ও অপরিণত বয়সে গর্ভধারণের ঝুঁকি সম্পর্কে অবগত করতে হবে। মেয়েদের কাছে যথাযথভাবে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় অভিভাবকদের পাশাপাশি আমাদের সর্বস্তরের মানুষকে বাল্যবিয়ে রোধে যথাযথভাবে দায়িত্বশীল হতে হবে।
নাফিজ ইমতিয়াজ রুপক
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়