Print Date & Time : 19 July 2025 Saturday 3:06 am

কমিউনিটি ক্লিনিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় রোল মডেল

 

সেলিনা আক্তার: এক লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ যখন এক বিপুল জনসংখ্যার চাপে দিশেহারা হয়ে পড়ার কথা, সেই সময়ে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় এক অনন্য মডেল হিসেবে কমিউনিটি ক্লিনিক আজ বিশ্বনন্দিত। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার এই মডেলকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন দেশের তৃণমূল পর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মাত্র সাড়ে তিন বছরেই দেশের সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে তৎকালীন মহকুমা ও থানা পর্যায়ে স্বাস্থ্য অবকাঠামো গড়ে তুলেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার বাংলাদেশের সব মানুষকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনার লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে এই অনন্য কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালু করে, যা সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের দোরগোড়ায় সরকারের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার সুফল সরবরাহে বিপ্লব ঘটিয়েছে।

কমিউনিটি ক্লিনিক হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিন্তা প্রসূত একটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কার্যক্রম; যা ঈড়সসঁহরঃু ইধংবফ ঐবধষঃয ঈধৎব (ঈইঐঈ) অপারেশনাল প্ল্যানের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং বর্তমান সরকারের সাফল্যের এক উজ্জল দৃষ্টান্ত; যা দেশে-বিদেশে নন্দিত। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত গ্রামীণ জনগণ নিকটস্থ কমিউনিটি ক্লিনিক হতে সমন্বিত স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও পুষ্টি সেবা পাচ্ছেন। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে সারাদেশে মোট ১৪ হাজার ৮৯০টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণের পরিকল্পনা আছে। বর্তমানে সারাদেশে মোট ১৪ হাজার ২০০টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু আছে এবং ৬৭টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণকাজ চলমান আছে।

পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার এ মডেলটিই আজ বিশ্বব্যাপী সুনাম অর্জন করেছে।  সরকারের পাশাপাশি সামাজিক সংগঠন, বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় দেশের গ্রামীণ জনগণের দোরগোড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছ দেয়ার লক্ষ্যে সরকার ২০১৮ সালে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা  ট্রাস্ট আইন প্রণয়ন করেছে। স্থানীয় জনগণের জমিতে সরকারের টাকায় কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হয়। স্থানীয় জনগণই এই ক্লিনিক পরিচালনা করেন। এতে করে কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা সম্পর্কে এলাকাবাসীর মধ্যে যেমন সচেতনতা তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে সেবার গুণগত মান বজায় রাখতেও তারা ভূমিকা রাখেন। কমিউনিটি ক্লিনিক সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টি ও স্বাস্থ্য শিক্ষা দিয়ে থাকে। আবার এটি নারীর ক্ষমতায়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

স্বাস্থ্য খাতে বর্তমান সরকারের একটি ফ্লাগশিপ কর্মসূচি হলো কমিউনিটি ক্লিনিক। কমিউনিটি ক্লিনিক শুধু একটি উদ্যোগ নয়। কমিটি ক্লিনিক অনেকগুলো উদ্যোগের একসঙ্গে সমন্বয়। এই উদ্যোগের অধীনে তৃণমূল পর্যায়ে নিরবচ্ছিন্ন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে প্রতি ৬ হাজার জন মানুষের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। এই ক্লিনিকগুলোর মাধ্যমে গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণ দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সুযোগ লাভ করেছে। এর ফলে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলো এখন নারী, শিশু, বয়স্ক নাগরিকসহ সব প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। দেশের দরিদ্রদের, বিশেষত নারীদের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে এসব ক্লিনিক বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে। এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের ফলে এটা প্রতীয়মান হয়, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ব্যাপক আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

কমিউনিটি ক্লিনিকে জরুরি বা মারাত্মক রোগীর চিকিৎসা দেয়া হয় না। কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) প্রতি কর্মদিবসে এতে সেবাদান করেন। তাছাড়া স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারী প্রত্যেকে ন্যূনতম তিন দিন কমিউনিটি ক্লিনিকে উপস্থিত থেকে সেবাদান করেন। শুক্রবার ও অন্যান্য সরকারি ছুটির দিন ছাড়া সপ্তাহে ছয়দিন (শনি থেকে বৃহস্পতিবার) কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা দেয়া হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকে উল্লেখযোগ্য সেবাগুলো হলোÑ প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা, গর্ভবতী ও প্রসূতির স্বাস্থ্যসেবা, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা,  পরিবার পরিকল্পনা সেবা, পুষ্টি সেবা, ইপিআই, সাধারণ রোগ ও জখমের চিকিৎসা সেবা, অসংক্রামক রোগ শনাক্তকরণ ও রেফারেল; কিশোর-কিশোরী ও নববিবাহিত দম্পতিদের সেবা; কভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান, জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি ও টিকা প্রদানে সহযোগিতা প্রদান; স্তন ও জরায়ু মুখে ক্যান্সার প্রতিরোধ বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান, জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি ও ভায়া স্ক্রিনিং, নিবন্ধন করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রেরণ; জš§ ও মৃত্যু নিবন্ধীকরণ; জরুরি ও জটিল রোগীর রেফারেল সেবা; স্বাভাবিক প্রসব (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে); কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্ম এলাকার জনগণকে খানাভিত্তিক অনলাইন রেজিস্ট্রেশন ও হেলথ আইডি কার্ড প্রদান এবং অন্যান্য সেবা।

চার হাজারেরও অধিক কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থা রয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রায় ১ লাখ স্বাভাবিক প্রসব সম্পন্ন হয়েছে। উল্লেখ্য, সব কমিউনিটি ক্লিনিক টিকাদান কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহƒত হচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিকে যে রোগীগুলো জটিল এবং দুরারোগ্য রোগ নিয়ে আসে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে তাদের নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অথবা বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠানো হয়। এ ধরনের রেফারেল রোগীর সংখ্যা এখন পর্যন্ত এক কোটিরও বেশি। বিগত ৪ বছরে কমিউনিটি ক্লিনিক  থেকে মোট ৩৫ কোটি ৬০ লাখের বেশি সেবাগ্রহীতা স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেছেন। তার মধ্যে ৮ লাখ ৯০ হাজার জন গর্ভবতী মহিলা গর্ভকালীন সেবা গ্রহণ করেছেন। এছাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকে ৮০ হাজারের অধিক স্বাভাবিক প্রসব সম্পন্ন হয়েছে। ৩০ লাখ ২৬ হাজারের অধিক ৫ বছরের কম বয়সী শিশুকে কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা প্রদান করা হয়েছে।

কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো কেবল স্বাস্থ্যসেবার সুবিধাই দেয় না। এটি জনস্বাস্থ্য সমস্যাসমূহ এবং পেশাদার স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছ থেকে সেবা গ্রহণের গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে, এটি অপেশাদার এবং প্রথাগত স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর মানুষের নির্ভরতা হ্রাস করতে সাহায্য করে। অধিকন্তু, ক্লিনিকগুলো নারীদের তাদের ঘরের বাইরে গিয়ে স্বাস্থ্য পরিসেবা পেতে সাহায্য করছে। এর ফলে পূর্বে প্রচলিত বাড়িভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমের ব্যবহার কমিয়ে নারীদের ক্রমবর্ধমানহারে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে সেবা গ্রহণ করতে দেখা যায়। মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য, বিভিন্ন রোগের প্রাথমিক নির্ণয় ও পরীক্ষা, টিকাদান কর্মসূচি, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা এবং প্রয়োজনে উচ্চ-স্তরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রেফারেলসহ কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ইনসুলিন, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধসহ ৩০ ধরনের ওষুধ এবং স্বাস্থ্যসেবা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে প্রদান করে। এতে দেশের সামগ্রিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান কার্যক্রম উন্নততর হয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিকে গড়ে বছরে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার ওষুধ সরবরাহ করা হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ফলে বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষা পায় রোগীরা। ছোট ছোট সমস্যায় যখন কমিউনিটি ক্লিনিক চিকিৎসা সেবা দেয় তাতে রোগীকে উপজেলা, জেলা বা বড় হাসপাতালে আর যেতে হয় না। এতে শুরুতেই রোগীরা প্রাথমিক পর্যায়ের সেবা পেয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যায়। প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিতের ফলে মানুষের স্বাস্থ্যগত উন্নতি হয়েছে। বড় ধরনের রোগ থেকে মানুষ সতর্ক হতে পারছে। এতে দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। করোনা ও ইপিআইয়ের ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রমও ভূমিকা রেখেছে কমিউনিটি ক্লিনিক। এটি শুধু একটি একক উদ্যোগ নয়, এটি একাধিক মহৎ উদ্যোগের সম্মিলিত রূপ।

বিনামূল্যে সেবাদান সহজ করার জন্য কর্মরত সব সিএইচসিপিকে ল্যাপটপ ও মডেম দেয়া হয়েছে। বর্তমানে ৯৫.৪৭ শতাংশ কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ডিজিটালি অনলাইন রিপোর্টিং করা হচ্ছে। সেবা সহজীকরণের জন্য মাল্টিপারপাস হেলথ ভলান্টিয়ারের মাধ্যমে সিসিকর্ম এলাকায় অবস্থানরত খানার প্রত্যেক সদস্যের ডিজিটালি হেলথ ডেটা সংগ্রহ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ১১ লাখ গ্রামীণ জনগণকে হেলথ আইডি কার্ড দেয়া হয়েছে। ১০৭টি উপজেলায় এ কার্যক্রম চলমান। পর্যায়ক্রমে সারাদেশে হেলথ আইডি কার্ড দেয়া হবে। এছাড়া প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে বিভিন্ন প্রকার রেজিস্টার, ফরম, এএনসি কার্ড, জিএমপি কার্ড ইত্যাদি সরবরাহ করা হয়েছে। এসব রেজিস্টারে তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

জাতিসংঘে প্রথমবারের মতো কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। কমিউনিটিভিত্তিক সর্বজনীন স্বাস্থ্যপরিষেবা অর্জনে একটি অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি শিরোনামে বাংলাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক মডেল প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্ভাবনীমূলক নেতৃত্বকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনস্বরূপ জাতিসংঘের ৭০টি দেশ এই প্রস্তাবে কো-স্পনসর করেছে। জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক এই রেজুলেশনের অনুমোদনকে ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের বৈশ্বিক প্রচেষ্টায় এক অবিস্মরণীয় মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর কাছ থেকে যতগুলো পুরস্কার পেয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য। তার মধ্যে আবার কমিউনিটি ক্লিনিক সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে।