নিজস্ব প্রতিবেদক: আগামী অর্থবছরের বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে ৪ লাখ টাকা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। আগামী ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব নিয়ে গতকাল রোববার সিপিডি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে একথা বলেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, ‘জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী ছিল। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির তুলনায় খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেশি। এছাড়া শহরের চেয়ে গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার অনেক বেশি। সাধারণ মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। ড. ফাহমিদা বলেন, ‘এ পরিস্থিতিতে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো যৌক্তিক বলে আমরা মনে করি। আগামী অর্থবছর এটি বাড়িয়ে ৪ লাখ টাকা নির্ধারণ করা উচিত।’
বর্তমানে একজন করদাতার করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা নির্ধারণ করা আছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে তা আরও ৫০ হাজার টাকা বাড়ানোর কথা বলেছে সিপিডি। বর্তমানে, ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের প্রথম সাড়ে ৩ লাখ টাকার ওপর কর নেই। পরের প্রথম এক লাখ টাকার জন্য ৫ শতাংশ, পরবর্তী ৪ লাখ টাকার জন্য ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখ টাকার জন্য ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখ টাকার জন্য ২০ শতাংশ এবং বাকি অর্থের ওপর ২৫ শতাংশ হারে কর বসে। এছাড়া নারী করদাতা এবং ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা হলো ৪ লাখ টাকা। তৃতীয় লিঙ্গের করদাতা এবং প্রতিবন্ধী স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতার করমুক্ত আয়সীমা পৌনে ৫ লাখ টাকা। গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা করদাতার করমুক্ত আয়ের সীমা ৫ লাখ টাকা। আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পিতামাতা বা আইনানুগ অভিভাবকের প্রত্যেক সন্তান বা পোষ্যর জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা আরও ৫০ হাজার টাকা বেশি।
এদিকে, চলতি অর্থবছর শেষে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সিপিডি।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘চলতি অর্থবছর (২০২৪-২৫)-এর জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে মোট রাজস্ব সংগ্রহে মাত্র ৪.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বার্ষিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৩২.২ শতাংশ অর্জন করতে হলে বাকি সময়ে রাজস্ব আহরণে ৫৫.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রয়োজন, যা আসলে অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে।’ বর্তমান রাজস্ব সংগ্রহের ধারা অব্যাহত থাকলে অর্থবছরের শেষে রাজস্ব ঘাটতি ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি। ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সুচারুভাবে সম্পন্ন করা মূলনীতি হওয়া উচিত’ তুলে ধরে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘সেটা করতে হলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণ করা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল করা ও রাজস্ব ব্যবস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা উচিত। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের বিষয়গুলো মাথায় রেখেও বাজেট প্রণয়ন করা দরকার।’
সিপিডির বাজেট সুপারিশ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘৬০টি পণ্যের শুল্কহার নির্ধারিত সীমায় নামিয়ে আনতে হবে, যাতে বাণিজ্য ভারসাম্য বজায় থাকে। যাতে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের ধাক্কাটা আমরা সামলে আনতে পারি। রপ্তানিকারকদের সহায়তা করার জন্য অন্য ধরনের সহায়তার কথা চিন্তা করতে হবে।’
বাজেটের সুপারিশে এনবিআরের সংস্কার আনার কথা বলেছে সিপিডি। এসব সংস্কারের মধ্যে রয়েছে আধুনিক রাজস্ব কাঠামো প্রণয়ন, ডিজিটাইজেশন, সামঞ্জস্যপূর্ণ কর নীতি তৈরি করা, ঝামেলামুক্তভাবে কর দেয়ার ব্যবস্থা করা। অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসেই বাড়তি শুল্ক বসানোর যে নীতি গ্রহণ করেছে তাতে বাংলাদেশের রপ্তানির সুযোগ তৈরির সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। বরং বাংলাদেশের রপ্তানির সুযোগ ‘সীমিত ও স্থিমিত’ হওয়ার শঙ্কার কথা তুলে ধরেছেন তিনি। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির এই সম্মানীয় ফেলো বলেন, “বৈশ্বিক যে ‘ট্যারিফ ওয়ার’ শুরু করেছেন তিনি (ট্রাম্প) তার নেতিবাচক প্রভাব বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির ওপর পড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে পড়ার আশঙ্কা আছে এবং সেখানে চাহিদা যেটা আছে সেটার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাহলে আমাদের রপ্তানির যে সুযোগ সে সুযোগ কিন্তু কিছুটা সীমিত এবং স্থিমিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। কাজেই এটা কোনোভাবেই কাম্য না।”
এর আগেও ২০১৬ সালে ট্রাম্প প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর চীনের তৈরি পোশাকের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন তিনি। সে সময় বাংলাদেশে বাণিজ্য সম্প্রসারণের তথ্য মেলেনি, বরং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি কমে গিয়েছিল। আবার এই বছর বেড়েছেÑবলেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘সুতরাং এটার ফলে সরাসরি কোনো উপকার আমাদের হবে বলে মনে করি না।’
এর ব্যাখ্যায় এ অর্থনীতিবিদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৯৩ শতাংশ রপ্তানি হয় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক। চীনের যে তৈরি পোশাকের ওপর ৩৫ শতাংশের মতো শুল্ক বসানো হয়েছে, মূলত সেটা কৃত্রিম সুতার পোশাক (মেন মেইড ফাইবার), সুতি নয় (নন-কটন)। আর বাংলাদেশের পুরোটাই হলো সুতি কাপড়ের পোশাক।
তিনি বলেন, যে পণ্যে চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আরোপ করেছে সে পণ্যে বাংলাদেশ চীনের প্রতিযোগী নয়। তৈরি পোশাকের মধ্যে অন্তঃপোশাক যে বৈচিত্র্য সেটাও মাথায় রাখার কথা বলেন মোস্তাফিজুর রহমান। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “বিভিন্ন অর্থনীতিবিদরা যেটা বলছেন, এই ধরনের ‘ট্যারিফ ওয়ার’ উনি (ট্রাম্প) শুরু করেছেন, এর ফলে বৈশ্বিক যে প্রবৃদ্ধি তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং নেতিবাচক প্রভাব পড়বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধির ওপরও। তাদের যে চাহিদা সাধারণ জনগণের, সেটা কমবে এবং এটা মূল্যস্ফীতিও বাড়াবে যুক্তরাষ্ট্রে। তার ফলে কিন্তু তাদের চাহিদাও কমে যাবে আমদানির জন্য। ফলে আমাদের মতো দেশগুলো যারা রপ্তানি করছি, যে চাহিদাটা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সেটার ওপরও কিন্তু নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”