আশরোফা ইমদাদ: গল্পের অবতারণা করোনা-পূর্ববর্তী সময় এবং মিরপুর কাজীপাড়ার মিসেস শাহরিয়ারকে নিয়ে। চাকুরে মিসেস শাহরিয়ারের অফিস পল্টনে। আপাতদৃষ্টিতে ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী মনে হলেও মিসেস শাহরিয়ার অ্যাজমাসহ আরও নানা অসুখ-বিসুখ আছে। অ্যাজমার জন্য প্রায়ই তাকে ভুগতে হয় খুব। অফিসে যাওয়া-আসার পথে গাড়ির ধোঁয়া আর ধুলাবালিতে তার দম যেন আটকে আসে। গাদা গাদা ওষুধ আর ইনহেলারের ব্যবহার করতে করতে ক্লান্ত তিনি।
করোনাভাইরাসজনিত বৈশ্বিক এ মহামারিতে সারা বিশ্ব এখন লকডাউনে। দেশেও করোনার প্রাদুর্ভাবে লকডাউন করা হয় পুরো ঢাকা শহরসহ প্রায় সারা দেশ। রাস্তায় গাড়ি চলাচল প্রায় বন্ধ, জ্যাম নেই ঢাকার রাস্তায়। মানুষের ভিড়ও উধাও হয়ে গিয়েছে যেন হঠাৎ করেই। কিন্তু প্রয়োজনে আর জীবিকার তাগিদে মিসেস শাহরিয়ারকে এরই মধ্যে অফিসে যেতে হচ্ছে প্রায়ই। কিন্তু এখন তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। ইনহেলার তো নিতেই হচ্ছে না, এমনকি ওষুধ খাওয়ারও প্রয়োজন আর হচ্ছে না তার। শ্বাসকষ্ট, কাশি কিছুই তার আর নেই এখন। ঢাকার বাতাস আগের মতো আর দূষিত নয়। বাতাস যেন হালকা, সতেজ আর নির্মল!
বিভিন্ন কারণে সৃষ্ট সবচেয়ে খারাপ বাতাসের মানে শীর্ষ ১০ শহরগুলোর মধ্যে আমাদের দেশেরও অবস্থান ছিল টানা বেশ কিছু বছর। অসহনীয় বায়ুদূষণ ঢাকাকে বাতাসের মানের দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম খারাপ শহরের আখ্যাও দিয়েছিল। বর্ধমান জনসংখ্যা, জীবাষ্ম জ্বালানি ও শিল্পায়নের কারণে বায়ুদূষণে জর্জরিত পৃথিবীর অন্যান্য দূষিত বায়ুর শহরের সঙ্গে ঢাকা শহরের নামও ছিল।
কিন্তু করোনাভাইরাস বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে মহামারিরূপে আবির্ভূত হলেও কিছু ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে, বিশেষ করে পরিবেশ এবং বায়ুদূষণের বেলায় করোনার প্রভাব অত্যন্ত ইতিবাচক। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশ্বের সব দেশেই মানুষকে নিজ ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। সামাজিক দূরত্বসহ বেশকিছু বিধিনিষেধ মেনে চলতে বলা হয়েছে কঠোরভাবে। এসব বিধিনিষেধ বিশ্ব অর্থনীতিকে অবিচ্ছিন্ন পতনে ফেলেছে ঠিকই, তবে এর ফলে বিশ্বের দূষণ কমেছে আশাতীতভাবে। বিশ্বের বেশিরভাগ দূষিত শহরগুলোর বাসিন্দাদের করোনা এমন কিছু দিয়েছে, যা তারা বছরের পর বছর অনুভব করেনি। পরিবেশের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের সবার জন্য এ উপহার হলো পরিচ্ছন্ন নির্মল বাতাস।
আইকিউয়ার একটি বৈশ্বিক বায়ুমানের তথ্য ও প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট সংস্থা। এতে কর্মরত গবেষকরা সারা বিশ্বের ১০টি বড় শহরের বায়ুর মান গবেষণা করেছে, যেখানে তুলনামূলকভাবে উচ্চসংখ্যক করোনাভাইরাস কেস এবং কভিড-১৯-এর কারণে শহরগুলো লকডাউন ব্যবস্থার আওতায় রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠান গবেষণা করে শহরগুলোতে ক্ষয়ক্ষতিযুক্ত মাইক্রোস্কোপিক পার্টিকুলেট পদার্থের পিএম স্ট্যান্ডার্ড ২.৫ পিএমের স্তরের সঙ্গে তুলনা করে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। তাতে দেখা গেছে, ১০টি শহরের মধ্যে ৭টি শহরেরই বায়ুর গুণগত মান উন্নত হয়েছে। এমনও দেখা গেছে, দূষণের উচ্চ স্তরের শহরের মানুষরাও দূষণের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নিন্মহার প্রত্যক্ষ করেছেন এ করোনাকালে।
দেখা গেছে, স্বাভাবিক সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ বায়ু মানজনিত দূষণে ভুগছে এমন বড় শহরগুলোতে তিন সপ্তাহের লকডাউনের সময় গত বছরের তুলনায় মারাত্মক বস্তুকণা উপাদান হ্রাস পেয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ বায়ু মানের সূচক অনুসারে গত কয়েক দিনে প্রায় শূন্য কার্বণ নিঃসরণ ঢাকার বায়ুকেও আবারও শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অত্যন্ত সুখকর ও স্বাস্থ্যকর হিসেবে পরিণত করেছে।
নাসার গ্লোবাল মডেলিং এবং ডেটা অ্যাসিমিলেশন টিমের ডেটার ভিত্তিতে রয়টার্স বলছে, লকডাউনের আওতায় নির্দেশিত ব্যবস্থাগুলো দূষণের স্তরে নাটকীয় প্রভাব ফেলেছে এবং সারা বিশ্বে বায়ুর মান আশাতীতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সঙ্গে দেশেও, বিশেষ করে ঢাকা শহরে ঋতুকালীন স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের সঙ্গে সঙ্গে করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে যানবাহন চলাচল এবং বন্ধ শিল্পের ওপর চলমান সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে বাতাসের মানের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। লকডাউনের কারণে কম জনসমাগম, সীমিত বা বন্ধ গণপরিবহন, বন্ধ কলকারখানা বায়ুর মান উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। ধোঁয়াহীন শহরে বায়ু আরও নির্মল আর পরিষ্কার হয়েছে। সতেজতা ফিরিয়ে দিয়েছে যেন জীবনে।
নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড প্রাথমিকভাবে জ্বালানি জ্বালানো থেকে বাতাসে মিশে যায়; যা প্রধানত গাড়ি, ট্রাক এবং বাস, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং রাস্তাঘাট মেরামতের সরঞ্জাম থেকে নির্গত হয়। দেশব্যাপী লকডাউনের কারণে এ সংশ্লিষ্ট বেশিরভাগ কার্যাবলি হ্রাস পাওয়ায় কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে এবং তা উল্লেখযোগ্য হারে। বিপুল পরিমাণ পরিবহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে ঢাকা শহরের বাতাসেও কার্বন নিঃসরণ ব্যাপকহারে হ্রাস পেয়েছে। ফলে বায়ু নির্মল এবং পরিষ্কার হচ্ছে। ইতোমধ্যে ঢাকার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) স্কোর নিয়মিতভাবে ৯৮ রয়েছে, যা স্বাভাবিক সময়ে ৫১ থেকে ১০০-এর মধ্যে থাকে। এ অবস্থায় ঢাকার বায়ুর গ্রহণযোগ্য গুণমানের কারণে দীর্ঘ সময় পর একে মাঝারি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে, যা করোনা-পূর্ববর্তী সময়ে আরও নি¤œমানে ছিল।
বায়ুদূষণ রোধে সরকার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে প্রথম থেকেই। ঢাকার বায়ুদূষণ মোকাবিলা ও পরিবেশ রক্ষায় সরকার একাধিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ঢাকার বায়ুদূষণের ৫৮ শতাংশ হয় ইটভাটাগুলো থেকে। বর্তমানে ঢাকাসহ এর আশপাশের এলাকাগুলোতে চলমান ইট ভাটাগুলো বন্ধের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পরিবেশবান্ধব ইট তৈরিতে কাজ করছে সরকার। ২০২৫ সালের মধ্যে ভাটাতে ইট পোড়ানো বন্ধ করার পরিকল্পনাও রয়েছে। সরকারি প্রকল্পের আওতায় ভবন নির্মাণে ব্লক ইট ব্যবহার করারও পরিকল্পনা করছে সরকার। যে মিল ও ফ্যাক্টরিগুলো পরিবেশবান্ধব নয়, সেগুলো শিগগিরই ঢাকার বাইরে স্থানান্তর করারও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে মেট্রোরেল প্রকল্পের কর্তৃপক্ষকে শহরের রাস্তায় যেখানে মেট্রোরেলের কাজ চলছে, সেখানে পানি স্প্রে করতে ও নির্মাণসামগ্রী এবং সাইটগুলোকে ঢেকে দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মেগা নির্মাণকাজের সময় পরিবেশে দূষণের বিস্তার রোধ এবং পরিবেশকে সুরক্ষা করতে ধুলা রোধ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সরকার এসব কার্যক্রম যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, তা মনিটর করা হচ্ছে। প্লাস্টিক ব্যাগের পরিবর্তে পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে সরকার।
করোনা মহামারি প্রাণহানিসহ আরও বহু ক্ষতি সাধন করলেও এর কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার বাতাসেও এখন আর নেই কোনো দূষণ, নেই কোনো ধোঁয়া। দেখা গেছে, বৈশ্বিক জলবায়ুতে মানুষ এখন নির্মল বাতাসে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আমাদের মনে রাখতেই হবে পরিবেশ ভালো থাকলেই কেবল আমরা ভালো থাকব। বিশ্বে করোনা মহামারি আমাদের শিখিয়ে যাচ্ছে কীভাবে ভালো থাকতে হয়, কীভাবে সুস্থ থাকতে হয়, কীভাবে যতœ নিতে হয় পরিবেশের। করোনাকাল কাটুকÑএ প্রত্যাশা সবার। স্বাভাবিক পৃথিবী আবার ফিরে আসুক। আমরা মমতা আর ভালোবাসা নিয়ে আমাদের পরিবেশের যতœ নেই। সে সঙ্গে পরিবেশ ও প্রকৃতির যত্নেও আমরা ভালো থাকি, ভালো থাকুক আমাদের প্রিয় পৃথিবী।
পিআইডি নিবন্ধ