ডা. মোহাম্মদ হাসান জাফরী: যত দিন যাচ্ছে, করোনা যেন বহুরূপীর মতো আরও নতুন নতুন রূপে আমাদের সামনে ধরা দিচ্ছে। সম্প্রতি আমাদের দেশে করোনার নাইজেরিয়ান ধরন শনাক্ত হয়েছে। করোনাভাইরাসের জিনোমের উম্মুক্ত তথ্যভাণ্ডার জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটার (জিসএআইডি) ওয়েবসাইটে বাংলাদেশে করোনার এ ধরন শনাক্ত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর আগে এ বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের দক্ষিণ আফ্রিকা, যুক্তরাজ্য ও ব্রাজিলের ধরনের অস্তিত্বের কথা জানিয়েছিলেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানীরা। আইসিডিডিআরবি, সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যৌথ গবেষণায় জানানো হয়, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলÑএই তিন দেশ থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের ধরন তিনটিই অনেক বেশি সংক্রামক, যা আমরা বছরের শুরুতে যুক্তরাজ্য ও ব্রাজিলের অবস্থার দিকে তাকালেই বুঝতে পারব। এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার ধরনটিও বেশ মারাত্মক, তবে এটি একবার হলে অনেক দিনই ইমিউনিটি দেয়, একথা বলছেন বিজ্ঞানীরা। বর্তমানে ভারত করোনা সংক্রমণের হটস্পটে পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, দেশে করোনার ভারতীয় ধরনটি ধরা পড়লে সেটি হবে খুবই ভয়ংকর। এখন দেশের মানুষের মধ্যে মূলত কোন ধরনটি বেশি রয়েছে, তা গবেষণা করে বের করা খুবই প্রয়োজন। কারণ ইমিউনিটি, ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা, সংক্রমণের ভয়াবহতা প্রভৃতি অনেক বিষয়ই এ তথ্যের ওপর নির্ভরশীল।
করোনার এই বহুরূপী প্রবণতার মধ্যেই ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে নতুন তথ্যের প্রমাণ দিয়েছে বিখ্যাত মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেট। এক নতুন পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস যে বায়ুবাহিত রোগ, তার সপক্ষে ‘ধারাবাহিক ও দৃঢ়’ প্রমাণ পেয়েছেন তারা। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ছয় বিশেষজ্ঞ ওই পর্যালোচনায় জানিয়েছেন, জনস্বাস্থ্য সংস্থাগুলো যদি বায়ুবাহিত ভাইরাস হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা না নেয়, তবে মানুষকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব নয়। ভাইরাসটি আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
তবে এ রিপোর্টটি কিছু ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে। অনেকেই মনে করছেন, ‘তাহলে আর মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই লকডাউনেরও।’ বিষয়টা আসলে এ রকম নয়। যক্ষ্মাও একটি বায়ুবাহিত রোগ। এ রোগীকেও আমরা মাস্ক পরা ও দূরত্ব বজায় রাখার মতো উপদেশ আগে থেকেই দিয়ে আসছি। বায়ুবাহিত রোগ মানে এই নয় যে, আশেপাশে কোনো কভিড রোগী নেই, কিন্তু বাতাসে ঘুরে অনেক দূর থেকে ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশ করছে। বায়ুবাহিত রোগ হতে হলেও আপনার আশেপাশে কভিড রোগী থাকতে হবে, তবে ড্রপলেটের তুলনায় বায়ুবাহিত রোগ একটু বেশি দূর পর্যন্ত ছড়াবে। অর্থাৎ আপনার কাছ থেকে কিছু দূরে অবস্থানরত রোগী থেকেও আপনার মধ্যে করোনা সংক্রমণ হতে পারে। সুতরাং সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক পরাÑএগুলোর প্রয়োজনীয়তা তো কমেইনি, বরং বেড়েছে। তাছাড়া ড্রপলেটের মাধ্যমে যে করোনা ছড়ায়, তা তো আগে থেকেই বলা হচ্ছে। সেজন্য মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং হাত ধোয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে নতুন করে বায়ুবাহিত রোগ হিসেবে আমাদের যে ব্যবস্থা নিতে হবে তা হলো, ঘরের ভেতর সুষ্ঠু বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা করা, ভিড় কমানো এবং আবদ্ধ জায়গায় (যেখানে বায়ু চলাচল সম্ভব নয়, যেমন এসি রুম) যথাসম্ভব কম থাকা, কারণ আবদ্ধ জায়গায় একই বাতাস বারবার আমাদের নিঃশ্বাসে প্রবেশ করে করোনার ঝুঁকি বাড়ায়। হাসপাতালে যক্ষ্মা রোগীকেও বারান্দার দিকে রাখা হয়, যেখানে পর্যাপ্ত উš§ুক্ত বাতাস চলাচল করে। তবে বাড়ির অভ্যন্তরে বা আশেপাশে কভিড রোগী থাকলে বাড়িতেও মাস্ক পরতে হবে, অন্যথায় বাড়িতে সবসময় মাস্ক না পরাই ভালো, কারণ তা অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমাতে পারে। মাস্কের গুণগত মান যাচাই করে মুখের আকারের সঙ্গে সঠিক মাপের মাস্ক পরতে হবে। দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্কপরা যদি অপ্রয়োজনীয়ই হতো, তাহলে লকডাউনসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় কভিড সংক্রমণ কমত না। করোনা তো নতুন করে বাতাসে ছড়াচ্ছে তা নয়, আগে থেকেই ছড়াচ্ছে; কিন্তু প্রমাণ মিলল এত দিন পর। সুতরাং আগের সব নিয়মই মানতে হবে, একই সঙ্গে ঘরে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। ধরন যা-ই হোক, বাতাসে ছড়াক বা ড্রপলেটের মাধ্যমে ছড়াকÑকরোনা মোকাবিলার সবচেয়ে কার্যকর পন্থা হচ্ছে মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও বারবার হাত ধোয়ার মতো স্বাস্থ্যবিধি পালন করা। সরকারের ঘোষিত ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ বিধিটি অত্যন্ত সময়োপযোগী, এটি যেন ভালোভাবে কার্যকর করা হয়, সেদিকে কড়া নজর দিতে হবে। সরকার বর্তমানে সারাদেশে লকডাউন দিয়েছে। এ লকডাউন ভালোভাবে মেনে চলার দায়িত্ব আমাদের। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হওয়া অত্যন্ত জরুরি। ধর্মীয় অনুষ্ঠান, জনসমাবেশ প্রভৃতি বিষয়েও বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সরকার। মার্কেটে অতিরিক্ত সতর্কতা এবং স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপারে সরকারের দেয়া নির্দেশনাগুলো নিজেদের সুরক্ষার জন্যই মেনে চলতে হবে। বিদেশ থেকে আসা-যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, ভারতের সঙ্গে স্থলবন্দরগুলো আপাতত আমদানি-রপ্তানি ছাড়া বন্ধ রয়েছে। বিদেশ থেকে কেউ এলেই বাধ্যতামূলকভাবে কোয়ারান্টাইনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকারের এসব উদ্যোগ খুবই প্রশংসনীয়।
কভিড মহামারি রোধের দ্বিতীয় কার্যকর উপায় হচ্ছে টিকা। টিকাদানের পর করোনা সংক্রমণ অনেক কমে যাবে। যদি সংক্রমণ হয়ও তবে তার তীব্রতা এবং হাসপাতালে ভর্তি বা মৃত্যুঝুঁকি অনেকটাই কমবে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে রাশিয়ার স্পুতনিক ও চীনের সিনোফার্মের টিকার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ভারত থেকেও টিকা আমদানি অব্যাহত থাকবে। বর্তমানে ভারতের করুণ দশায় তারা রপ্তানি আপাতত বন্ধ করলেও আমাদের দেশে যেন মানুষ টিকা পায়, সেজন্য এটি সরকারের একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। একই সঙ্গে দেশেও টিকা উৎপাদনের ব্যাপারে জোর দেয়া হচ্ছে। আমাদের দেশের উদ্ভাবিত বঙ্গভ্যাক্সসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রমাণ করে যে, চাইলে আমরাও পারি। তবে টিকা নেয়ার পরও যে মাস্ক পরা ও হাত ধোয়ার মতো স্বাস্থ্যবিধি ছাড়া যাবে না, সে বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে হবে। শুধু সরকারের পক্ষে স্বাস্থ্যবিধি পালনে বাধ্য করা সম্ভব নয়, যদি না মানুষ সচেতন হয়। তাই সচেতনতাই পারে আপনার পরিবারের ও অন্যের জীবন রক্ষা করতে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নেয়া হচ্ছে।
করোনায় জীবন রক্ষার ব্যাপারে সরকার যেমন কাজ করছে, পাশাপাশি জীবিকার দিকটাও ভাবতে হচ্ছে। লকডাউনের প্রারম্ভে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বলেন, ‘আমাদের সবাইকেই মনে রাখতে হবে, মানুষের জীবন সর্বাগ্রে। বেঁচে থাকলে আবার সবকিছু গুছিয়ে নিতে পারব।’ প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। কলকারখানায় যাতে উৎপাদন ব্যাহত না হয়, সে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। নেয়া হয়েছে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ। এ সময় প্রায় আড়াই কোটি মানুষকে বিভিন্ন সরকারি সহায়তার আওতায় আনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, ‘সরকার সবসময় আপনাদের পাশে আছে। কভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানার পর আমি দরিদ্র ও নি¤œবিত্ত মানুষকে সহায়তার জন্য কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছি। আমরা এরই মধ্যে পল্লি অঞ্চলে কর্মসৃজনের জন্য ৮০৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা এবং পবিত্র রমজান ও আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ৬৭২ কোটির বেশি টাকা বরাদ্দ দিয়েছি। এর মাধ্যমে দেশের প্রায় এক কোটি ২৪ লাখ ৪২ হাজার নি¤œবিত্ত পরিবার উপকৃত হবে।’
২০১৯-২০ অর্থবছরে মুজিববর্ষে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৩৫ লাখ পরিবারকে নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান করা হয়। পরিবারপ্রতি দুই হাজার ৫০০ টাকা করে ৮৮০ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা সরাসরি উপকারভোগীর মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রদান করা হয়েছিল। এ বছরও পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে কভিড এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত সাড়ে ৩৬ লাখ পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রতিটি পরিবারকে মাথাপিছু দুই হাজার ৫০০ টাকা করে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। ২ মে থেকে সাড়ে ৩৬ লাখ পরিবারকে সরাসরি ইএফটি’র মাধ্যমে তাদের নির্দিষ্ট মোবাইল ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এ অর্থ সহায়তা পাঠানো হয়েছে। এছাড়া গত ৪ এপ্রিল সংঘটিত ঝড়ো হাওয়া, শিলাবৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড়ে দেশের এক লাখ কৃষক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কভিড-১৯-এর ফলে কর্মহীন এবং ক্ষতিগ্রস্ত এসব কৃষককে জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা হারে আর্থিক সহায়তা প্রদানের বিষয়টি বিবেচনার সুপারিশ করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
করোনার নতুন নতুন ধরন মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে, নেবে। আমাদের মতো জনবহুল দেশে যদি আমরা নিজেরা সচেতন না হই, তবে কোনোভাবেই জীবন ও জীবিকা বাঁচানো সম্ভব হবে না। তাই এখনই সময় আরও বেশি সচেতন হওয়ার।
পিআইডি নিবন্ধ