সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) প্রভাবে দেশের অধিকাংশ ইস্পাত কারখানার উৎপাদন প্রায় ৫০ শতাংশ কমে যায়। এর মধ্যে বন্যার প্রভাবও ছিল। সব মিলিয়ে এপ্রিল থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত বিক্রয় ও উৎপাদন নিয়ে অনেকটা অতৃপ্ত ছিলেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে আন্তর্জাতিক বাজারের স্ক্র্যাবে দাম বৃদ্ধির পাওয়ায় দেশের বাজারে টনপ্রতি চার থেকে ছয় হাজার টাকা বেড়েছে ইস্পাতের দাম। অথচ করোনা সংক্রমণে কমেছে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নির্মাণ কার্যক্রম।
আন্তর্জাতিক বাজারে ইস্পাত উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল স্ক্র্যাপের সংকট দেখা দেয়ায় প্রতিদিন বাড়ছে দাম। পাশাপাশি ব্যবহƒত কেমিক্যালের দামও বাড়ছে। এছাড়া স্থানীয় বাজারের জাহাজ ভাঙা কম হওয়ায় সংকট আছে স্ক্র্যাপের । এর মধ্যে চলতি মাসে টনপ্রতি দাম বেড়েছে ৯০ ডলার। অর্থাৎ আগের সপ্তাহে ছিল ৩০০ ডলার, যা চলতি সপ্তাহে বেড়ে হয়েছে ৩৯০ ডলার। যার প্রভাবে দেশের বাজারের আট হাজার করে বেড়েছে স্ক্র্যাপের দাম। এ কারণে কয়েকদিন ব্যবধানে টনপ্রতি চার থেকে ছয় হাজার টাকা বেড়েছে ইস্পাত পণ্যেও।
অথচ করোনা সংক্রমণের কারণে ৫০ শতাংশের বেশি নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে গেছে। যদিও চলতি বছরের মার্চেও শেষ থেকে করোনার প্রভাব, বন্যার প্রভাবে প্রায় সাত মাস ইস্পাত কারখানারগুলো উৎপাদন ও বিক্রয় গড়ে ৫০ শতাংশের মতো ছিল। এ কারণে অনেকটা হতাশ ছিল ইস্পাত খাতের উদ্যোক্তারা। তবে ব্যবসায়ীদের দাবি নির্মাণ মৌসুম হওয়ার কারণে চাহিদা আগের চেয়েও কিছুটা বেড়েছে।
ইস্পাত শিল্প মালিকদের মতে, দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ইস্পাত খাত। এ খাতের কারখানাগুলোর ইস্পাত পণ্য উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ৮০ লাখ টন। এর বিপরীতে বছরে চাহিদা ৫০ লাখ টনের মতো। কারখানা জোগান দিয়েছে দেশের বড় বড় মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, টানেল, ছোট-বড় সেতু, শিল্প স্থাপনা। যদিও এ খাতে সক্রিয় শতাধিক প্রতিষ্ঠান। তবে মোট চাহিদার অর্ধেকের বেশি মেটায় শীর্ষ আবুল খায়ের স্টিল, বিএসআরএম, কেএসআরএম, জিপিএইচ, আরএসআরএম। গত এক মাসে এসব ইস্পাত কারখানার প্রায় ছয় লাখ টন উৎপাদিত পণ্য অবিক্রীত রয়ে গেছে।
বাজার পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, সম্প্রতি পাইকারি বাজরে রডের দাম ছিল ৫৫ থেকে ৬১ হাজার টাকা। এর মধ্যে বিএসআরএম ছিল টনপ্রতি ৬১ হাজার টাকা, কেএসআরএম ৬০ হাজার টাকা, আরএসআরএম ৫৭ হাজার টাকা, একেএস ৫৬ হাজার টাকা, গোল্ডেন ইস্পাত ৫৫ হাজার টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে টনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকার কম ছিল।
ইস্পাতের বৃহৎ প্রতিষ্ঠান কেএসআরএমের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত বলেন, সাম্প্রতিক সময় বিশ্ববাজারে ইস্পাত স্ক্র্যাপের তীব্র ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। তাই ক্রমাগত বাড়ছে ইস্পাতের দাম। বিগত দুই বছর স্ক্র্যাপের দাম অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এখনও দাম বৃদ্ধির সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে বিশ্ববাজারে। ৩০০ ডলার থেকে গত এক মাসে স্ক্র্যাপের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে টনপ্রতি ৩৯০ ডলারে। অর্থাৎ বেড়েছে ৯০ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় আট হাজার টাকা। তবে উদ্বেগের বিষয় হলোÑস্থানীয় বাজারে স্ক্র্যাপের ঘাটতি আছে। অথচ ইস্পাত শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার জন্য এবং পার্সেল বুকিংয়ের জন্য অব্যাহত চাপ প্রয়োগ করছে। এছাড়া চীন ইতোমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছে তাদের দেশে স্ক্র্যাব আমদানির অনুমতি দেবে, যা বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও সংকটের দিকে নিয়ে যাবে। তখন বাংলাদেশে ইস্পাত উৎপাদনের বর্তমান সক্ষমতা বজায় রাখাও কঠিন হয়ে পড়বে। এ প্রভাব পড়েছে স্থানীয় বাজারে। সুতরাং আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে রডের দাম নির্ধারণ না করা হলে ইস্পাত খাত হয়ে পড়বে স্থবির। অথচ এসব শিল্পোদ্যোক্তাদের ওপর রয়েছে বাড়তি করের বোঝা।
গোল্ডেন ইস্পাত লিমিটেডের পরিচালক মোহাম্মদ সরোয়ার আলম শেয়ার বিজকে বলেন, এক সপ্তাহ ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারের স্ক্র্যাপের বুকিং রেট ৯০ ডলার বেড়েছে। গতকাল ৩৯০ ডলারের বুকিং নেওয়া হয়। আর এসব বুকিংয়ের মাল পাওয়া যাবে আগামী জানুয়ারিতে। আমাদের কাছে আসবে আরও দেড় মাস পর। আবার লোকাল বাজারের স্ক্র্যাপের ঘাটতি আছে। কারণ গত কয়েক মাস তেমন স্ক্র্যাপ জাহাজ কাটা হয়নি। এছাড়া ইস্পাত ব্যবহƒত বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যালের দামও বাড়ছে। আগামী কয়েক মাস দাম বাড়বে। করোনার কারণে আমরা এত লোকসানে ইস্পাত বিক্রয় করছি। যদিও নির্মাণ মৌসুম হওয়ায় আগের চেয়ে কিছুটা বিক্রয় বেড়েছে।